টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ফসলি জমি এবং সংরক্ষিত বনভূমি ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে একের পর এক ইটভাটা। বর্তমান সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১০৮-এ, যার মধ্যে বেশিরভাগই অবৈধ। এই ইটভাটাগুলো শুধু জমি ও প্রকৃতির ক্ষতিই করছে না, মানুষের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোর সীমিত পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ইটভাটা
ইটভাটার দাপট: কৃষকের জীবিকা হুমকিতে
মির্জাপুরের বেশিরভাগ ইটভাটা আবাদি জমি দখল করে স্থাপন করা হয়েছে। গ্রামের কৃষকরা অভিযোগ করছেন, তারা জমি হারাচ্ছেন এবং ক্ষতিপূরণও ঠিকমতো পাচ্ছেন না।
- এক কৃষক বলেন, “আমাদের জমি জোর করে কিনে নিচ্ছে। আমি বাধা দিয়েছিলাম, কিন্তু তারপরে হুমকি পেয়ে আর কিছু বলতে পারিনি। এখন ফসল ফলানোর জন্য জমি নেই।”
- ইটভাটার জন্য পাহাড়ি মাটি এবং আবাদি জমির মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে, যার ফলে জমির উর্বরতা ধ্বংস হচ্ছে।
ইট তৈরির জন্য ব্যবহৃত মাটির কারণে কৃষি জমি পুকুরে রূপান্তরিত হচ্ছে। এতে শুধু জমি হারাচ্ছেন কৃষকরা নয়, স্থানীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পরিবেশের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব
অবৈধ ইটভাটাগুলোর কারণে মির্জাপুরের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
- বায়ুদূষণ: ইট পোড়ানোর ধোঁয়া বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। আশপাশের গ্রামগুলোতে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এবং অন্যান্য শ্বাসজনিত রোগ বাড়ছে।
- বনভূমি ধ্বংস: সংরক্ষিত বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে, যা স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি।
- শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি: কিছু ইটভাটা বিদ্যালয়ের পাশে স্থাপিত হয়েছে, যার ফলে শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “আমাদের গ্রামে যে বিশুদ্ধ বাতাস ছিল, তা এখন ধোঁয়ার কারণে বিষাক্ত হয়ে গেছে। বাচ্চারা শ্বাস নিতে কষ্ট পায়।”
আইন উপেক্ষা: একটি নিয়মিত ঘটনা
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, ইটভাটা স্থাপনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র, ট্রেড লাইসেন্স, এবং ডিসি অফিসের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। কিন্তু মির্জাপুরে বেশিরভাগ ইটভাটায় এসব কাগজপত্র নেই।
- পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নবায়ন ছাড়াই ইট পোড়ানো অব্যাহত রয়েছে।
- কিছু ইটভাটায় বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
- স্থানীয় প্রশাসন এবং বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কিন্তু কার্যকর উদ্যোগের অভাব স্পষ্ট।
সরকারি নির্দেশনা এবং বাস্তবতা
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা সম্প্রতি মির্জাপুর পরিদর্শনে এসে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এলাকাবাসী অভিযোগ করছেন, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি আগেও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর বলেছে, অভিযানের কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু কার্যকর কোনো পরিবর্তন এখনও দেখা যাচ্ছে না।
ভবিষ্যৎ কী হতে পারে?
অবৈধ ইটভাটা শুধু মির্জাপুর নয়, সারা দেশের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি। আবাদি জমি, বনভূমি এবং স্থানীয় জনস্বাস্থ্যের ওপর এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী।
এক পরিবেশকর্মী বলেন, “আমরা যদি এখনই উদ্যোগ না নেই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শূন্য হাতে রেখে যেতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।”
পরিবেশ রক্ষায় করণীয়
এই সংকট সমাধানে প্রশাসন এবং স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
- অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
- পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইট তৈরি করতে উৎসাহিত করতে হবে।
- স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার জন্য প্রচার কার্যক্রম চালানো দরকার।
আপনার ভূমিকা কী?
পরিবেশ রক্ষা শুধু প্রশাসনের দায়িত্ব নয়। এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। যদি আপনার এলাকায় এমন অবৈধ কার্যক্রম চলতে দেখেন, তা প্রশাসনের নজরে আনুন। পরিবেশ বাঁচাতে সচেতন হন এবং অন্যদের সচেতন করুন। আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগেই সম্ভব প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা।