কুতুবদিয়ার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প: পরিকল্পনার অভাব নাকি দুর্নীতি?
কুতুবদিয়া দ্বীপ, যেখানে সমুদ্রের বাতাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার কথা ছিল, সেখানে এখন পড়ে আছে মরিচা ধরা বায়ুকল এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত যন্ত্রপাতি। দেশের প্রথম এবং সর্ববৃহৎ বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প দুটি আজ ধ্বংসের মুখে। স্থানীয় বাসিন্দারা একে “হারানো স্বপ্ন” এবং “বোঝা” বলে অভিহিত করেন। কেন এই প্রকল্প ব্যর্থ হলো, এবং এর পেছনের কারণগুলো আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
কুতুবদিয়ার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প: আশা থেকে হতাশা
২০০৭ সালে শুরু হওয়া দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ছিল ৫০টি বায়ুকলের মাধ্যমে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ। ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্পটি শুরুতেই আশার আলো জ্বালালেও তা কয়েক দিনের মধ্যেই নিভে যায়। যান্ত্রিক ত্রুটি এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ২০১৬ সালে দ্বিতীয় প্রকল্পটি চালু করা হয়। ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই এটি অচল হয়ে পড়ে। বর্তমানে দুটি প্রকল্পেরই বায়ুকলগুলো মরিচা ধরে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় রয়েছে।
প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা: ধ্বংসাবশেষের গল্প
পরিত্যক্ত বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থা দেখে সহজেই বোঝা যায় এটি কতটা অবহেলায় পড়ে আছে। বায়ুকলগুলো হেলে পড়েছে, পাখাগুলো ভেঙে গেছে, আর যন্ত্রপাতিগুলো চুরি হয়ে গেছে। ভবনগুলো তালাবদ্ধ, এবং কেন্দ্রের জমিতে লবণ উৎপাদন চলছে।
স্থানীয়রা জানান, এই প্রকল্পের কোনো কার্যকর তদারকি নেই। এমনকি কেন্দ্রগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সবকিছুই ধ্বংসের পথে। এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “এটা এখন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কখনো এই প্রকল্পের সুফল পাইনি।”
কেন ব্যর্থ হলো বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প?
স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্পের ব্যর্থতার মূল কারণ হলো দুর্নীতি, পরিকল্পনার অভাব এবং তদারকির ঘাটতি।
- ভুল স্থান নির্বাচন: যেখানে পর্যাপ্ত বাতাসের গতি নেই, সেখানে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হয়। প্রকল্প শুরুর আগে কোনো উপযুক্ত গবেষণা করা হয়নি।
- তদারকির অভাব: প্রকল্প চালু হওয়ার পরও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং তদারকির অভাব প্রকল্পটিকে ব্যর্থ করে তোলে।
- দুর্নীতি: স্থানীয়দের অভিযোগ, এই প্রকল্প মূলত অর্থ অপচয়ের একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। যন্ত্রপাতি কেনা থেকে শুরু করে পরিচালনা পর্যন্ত দুর্নীতি প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়।
জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ: নতুন সম্ভাবনার শুরু
২০২৩ সালে কুতুবদিয়া দ্বীপে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। এটি দ্বীপের ৯,৭০০ গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এখন নতুন করে আশার আলো দেখছেন। বিদ্যুৎ আসার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হচ্ছে, কৃষি উৎপাদন বাড়ছে, এবং মৎস্য খামার ও পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে।
এক স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, “বিদ্যুৎ আসার আগে আমরা অনেক সমস্যার মধ্যে ছিলাম। এখন ব্যবসা করার সুযোগ বেড়েছে, এবং নতুন উদ্যোগ নেওয়ার সাহস পাচ্ছি।”
বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে শিক্ষা: ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক বার্তা
কুতুবদিয়ার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যর্থতা আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে যে ঘাটতিগুলো রয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
- সঠিক পরিকল্পনা: প্রকল্প গ্রহণের আগে সঠিক গবেষণা এবং পরিকল্পনা করা জরুরি।
- দুর্নীতি রোধ: সরকারি প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি বন্ধ করতে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।
- তদারকি নিশ্চিত করা: প্রকল্প পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল এবং নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।
- জনগণের অংশগ্রহণ: স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাদের প্রয়োজন বুঝে প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত।
উপসংহার: উন্নয়ন প্রকল্পে দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন
কুতুবদিয়ার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে শুধু অর্থ বরাদ্দই যথেষ্ট নয়; বরং সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর তদারকি এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।
এই ব্যর্থতাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এমন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, যা জনগণের জীবনমান উন্নত করে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে।