“ঢাকার খাল উন্নয়ন বিশ্লেষণ: জলাবদ্ধতা নিরসন নাকি অর্থের অপচয়?”
ভূমিকা
ঢাকার চারটি প্রধান খাল—জিরানী, মান্ডা, শ্যামপুর এবং কালুনগর—সংস্কার ও পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ৮৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন এবং খালগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা।
তবে, প্রকল্পটি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। সেতু, ওয়াকওয়ে এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের নামে প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি খাল পুনরুদ্ধারের নামে একটি অর্থনৈতিক অপচয়।
ঢাকার জলাবদ্ধতা: প্রকৃত চিত্র
ঢাকা শহরের খালগুলো একসময় প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম ছিল। কিন্তু দখল, দূষণ, এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে আজ এই খালগুলোর অনেকাংশ বিলুপ্তপ্রায়। এর ফলে শহরে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি জমে থাকে, সড়ক ডুবে যায়, এবং মানুষের যাতায়াতে দুর্ভোগ বাড়ে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে খালগুলোর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা, জলাবদ্ধতা কমানো এবং শহরের পরিবেশ উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কি এটি সম্ভব?
জিরানী খালের বাস্তবতা: প্রয়োজন বনাম পরিকল্পনা
জিরানী খালে ইতিমধ্যেই ১৩টি সেতু রয়েছে। এর মধ্যে অনেক সেতুই প্রয়োজনীয়। কিন্তু প্রকল্পের অধীনে আরও ছয়টি সেতু এবং একটি ওয়াকওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জিরানী খালে নতুন করে সেতু নির্মাণের প্রয়োজন নেই। খালের দুই পাশে একদিকে বড় সড়ক এবং অন্যদিকে ঘন বসতি থাকায় ওয়াকওয়ে তৈরিরও কোনো বাস্তবতা নেই।
একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝা যায় প্রকল্পের সমস্যাগুলো। ২০২১ সালে জিরানী খালে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেতুটির অন্য প্রান্তে সড়ক না থাকায় এটি সাড়ে তিন বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ একই খালে নতুন সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মান্ডা, শ্যামপুর ও কালুনগর খালের উন্নয়ন: প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
- মান্ডা খাল: নতুন করে ২৮টি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে স্থানীয়দের মতে, এতগুলো সেতুর কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক সেতু ইতিমধ্যেই ব্যক্তি উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে।
- শ্যামপুর খাল: এখানে ১৫টি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত না করে এসব সেতু নির্মাণ আদৌ কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
- কালুনগর খাল: আটটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, এতগুলো সেতুর বাস্তব চাহিদা নেই।
ব্যয়ের অস্বচ্ছতা: প্রকল্পে অর্থের অপচয়
প্রকল্পের ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে পলি অপসারণ এবং বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপনে বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়ে।
- পলি অপসারণ: খালগুলো থেকে পলি অপসারণের জন্য ৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ ২০২১ সালে একই কাজ দেড় কোটি টাকায় সম্পন্ন করা হয়েছিল। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার বেশি পলি অপসারণ করা হবে। তবে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন ব্যয় এত বেশি ধরা হয়েছে।
- বিদ্যুতের খুঁটি: ৭৭১টি বিদ্যুতের খুঁটি বসানোর জন্য ৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রতিটি খুঁটির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, যেখানে সাধারণত খরচ হয় ৬৫-৭০ হাজার টাকা।
- অন্য ব্যয়: খালগুলোর পাশে খাবারের দোকান নির্মাণের জন্য ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
নগর পরিকল্পনার ঘাটতি: কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে খালগুলোর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু প্রকল্পে সেতু, ওয়াকওয়ে এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
তাঁদের মতে, এই প্রকল্পে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। স্থানীয় জনগণের মতামত ছাড়াই এমন অনেক পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করলে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে না।
খাল পুনরুদ্ধারে টেকসই নীতি প্রয়োজন
ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকৃত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তবে সেতু এবং ওয়াকওয়ের মতো অবকাঠামো নির্মাণের চেয়ে নিম্নলিখিত বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার:
- পানিপ্রবাহ সচল রাখা: খালগুলো থেকে অবৈধ দখল সরিয়ে স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা।
- বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার: খাল ও এর আশপাশের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
- স্থানীয় সম্পৃক্ততা: স্থানীয় জনগণের মতামত নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
- খরচের স্বচ্ছতা: প্রকল্পের প্রতিটি খরচ সঠিকভাবে নিরীক্ষণ করা।
সমাপ্তি: উন্নয়নের নামে অপচয় বন্ধ হোক
ঢাকার খাল পুনরুদ্ধার প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এটি শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং অস্বচ্ছ ব্যয়ের কারণে প্রকল্পটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
সঠিক পরিকল্পনা, স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা এবং টেকসই নীতিমালা গ্রহণ করলেই এই প্রকল্পটি সফল হতে পারে।
আপনার মতামত দিন: ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে আপনার কী পরামর্শ? মন্তব্য করে জানান এবং সচেতনতা বাড়াতে পোস্টটি শেয়ার করুন।