ঢাকা, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে। যেখানে বাইরের দূষণ নিয়ে আমরা প্রায়ই আলোচনা করি, সেখানে ঢাকার ঘরের ভিতরের বায়ুদূষণও ক্রমেই একটি গম্ভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি যখন জানালা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে বসে থাকেন, তখন হয়তো ভাবছেন বাইরে যে দূষণ হচ্ছে, সেটি কি আপনার শরীরে কোনো ক্ষতি করতে পারে? সম্প্রতি একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, ঘরের ভিতরের বায়ুদূষণ ঢাকার বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস, যা আমাদের স্বাস্থ্যকে অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
ঢাকার অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ: একটি অজানা বিপদ
ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ নিয়ে যেভাবে আমরা সচেতন নই, তা আমাদের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেট্রিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে সম্প্রতি একটি গবেষণা চালানো হয়, যেখানে ঢাকা শহরের ৪৩টি বাসাবাড়ির অভ্যন্তরীণ বায়ুর গুণমান পর্যালোচনা করা হয়। এই গবেষণার ফলাফল চমকপ্রদ: প্রতিটি ঘরের গড় বায়ু দূষণের মাত্রা ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ মানের প্রায় পাঁচগুণ বেশি।
গবেষণায় এমনও কিছু ঘর পাওয়া গেছে, যেখানে দূষণের মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামের বেশি ছিল, যা স্বাস্থ্যগতভাবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই ধরনের দূষণ বাড়িয়ে দিতে পারে শ্বাসযন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং এমনকি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যাও।
ঘরের বায়ু দূষণের কারণ
ঢাকার ঘরবাড়ির ভিতরের বায়ু দূষণের বেশ কিছু মূল উৎস রয়েছে:
- রান্না: রান্নার সময় ছড়িয়ে পড়া গ্যাস, ধোঁয়া এবং বাষ্প ঘরের বাতাসে ক্ষতিকর উপাদান যোগ করে। সিগারেটের ধোঁয়াও দূষণ বাড়ায়।
- নির্দিষ্টভাবে না পরিষ্কার করা বর্জ্য: খাবারের বর্জ্য বা পুরনো আসবাবপত্র থেকে বের হওয়া কেমিক্যাল ধোঁয়া ঘরের বাতাসকে দূষিত করে।
- পশু-পাখির ময়লা: ঘরে পোষা প্রাণী থাকলে তাদের ময়লা এবং গন্ধও দূষণের কারণ হতে পারে।
- পুরনো বিল্ডিং এবং আসবাবপত্র: পুরনো বিল্ডিং এবং আসবাবপত্র থেকে উত্পন্ন কেমিক্যাল বা বৃষ্টির কারণে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক বৃদ্ধি পায়, যা বায়ু দূষণের ঝুঁকি বাড়ায়।
সমস্যা এবং সমাধান
ঘরের ভিতরের বায়ু দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- জানালা বন্ধ রাখা: বাইরে দূষণের মাত্রা বেশি থাকলে ঘরের জানালা বন্ধ রাখা অত্যন্ত কার্যকর। এক গবেষণায় দেখা গেছে, জানালা বন্ধ রাখলে বাইরের পিএম ২.৫ দূষণের ৬৮% পর্যন্ত প্রবাহ রোধ করা যায়।
- এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করা: হেপা ফিল্টারসহ এয়ার পিউরিফায়ার ঘরের বাতাসে থাকা ক্ষতিকর উপাদানগুলো শোষণ করে, বিশেষ করে পিএম ২.৫ দূষণ অনেকটাই কমায়।
- ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা: রান্নাঘরের ভেন্টিলেশন ঠিকভাবে ব্যবহার করা, যাতে রান্নার সময় বের হওয়া ধোঁয়া ও গ্যাস বাইরে চলে যায়।
- ঘর নিয়মিত পরিষ্কার রাখা: ধুলোবালি, পশু-পাখির ময়লা, বর্জ্য সবকিছু পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে বায়ু দূষণ কমানো যায়।
গবেষকরা আরও জানিয়েছেন যে, ঘরের অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের মাত্রা যদি কমানো যায়, তবে শহরের বাইরের বায়ু দূষণ থেকে মানুষ কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। এটি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।
ঢাকার বায়ু দূষণের চ্যালেঞ্জ
ঢাকা শহরের দ্রুত নগরায়ন, যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া, নির্মাণ কাজের ধুলা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব—এসবই ঢাকার বায়ু দূষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে শুধু বাইরের দূষণ নয়, আমাদের ঘরের বায়ু দূষণও আমাদের স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলছে। বাড়ির ভিতরে থাকা বায়ু দূষণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
ঢাকার বায়ুদূষণ একটি বহুমাত্রিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে বাইরের দূষণ এবং অন্যদিকে ঘরের ভিতরের দূষণ—দুটোই আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। তবে সমস্যা যত বড়ই হোক, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও রয়েছে। ঘরের বায়ু দূষণ কমাতে বেশ কিছু সহজ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, যা আমাদের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে সহায়ক হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক পদক্ষেপ নিলে, আমরা ঢাকার বায়ু দূষণের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেতে পারি।