কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক কাছিমেরা তাদের প্রাকৃতিক আচরণের অংশ হিসেবে ডিম পাড়তে শুরু করেছে। সেন্ট মার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপে গত তিন রাতেই মৌসুমের প্রথম তিনটি কাছিম ডিম দিয়েছে। তবে, এই প্রাকৃতিক ঘটনাও এখন আর আগের মতো সহজ নয়। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের পরিবেশগত কার্যকলাপের কারণে কাছিমদের ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠছে, যেখানে কাছিমদের আগমন আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
কাছিমের ডিম পাড়ার সময় পিছিয়ে গেছে
প্রতিবছর শীত মৌসুমে, প্রায় নভেম্বর থেকে, কাছিমেরা কক্সবাজারের বালুচরে এসে ডিম পাড়ে। কিন্তু এবারের মৌসুমে ডিম পাড়ার সময়ও পিছিয়ে গেছে। গত বছরের তুলনায় এবার ২২ দিন পরে, প্রথম কাছিমটি সাগর থেকে উঠে এসে ১০৫টি ডিম দিয়ে গেছে। এরপর শিলবুনিয়া সৈকতে আরেকটি কাছিম ১৪৪টি ডিম দিয়েছে। তবে, এই সাধারণ প্রক্রিয়াটিও আজকাল আর এতটা সহজ নয়।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশগত সমস্যা
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের শিলবুনিয়া সৈকত, যেখানে সাধারণত কাছিমেরা ডিম পাড়ে, সেখানে এখন নানা বাধা দেখা দিয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল হয়ে উঠেছে যে, কাছিমরা সহজে বালুচরে উঠতে পারছে না। সৈকতের আলোকসজ্জা, পর্যটকদের হৈ-হুল্লোড় এবং কুকুরের উৎপাত এই প্রাণীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে অন্তত ৮-১০টি রিসোর্ট রয়েছে, যার কারণে পুরো সৈকত রাতের বেলায় আলোকিত হয়ে যায়, যা কাছিমদের জন্য বিপদজনক। এর মধ্যে আবার পর্যটকরা সৈকতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করলে কাছিমরা আরও বেশি সমস্যায় পড়ছে।
মৃত কাছিম এবং ডিমের সংগ্রহ: গত বছর কী ঘটেছিল?
গত বছর কক্সবাজারের উপকূলে শতাধিক মৃত কাছিম ভেসে এসেছিল, যেগুলো ডিম পাড়ার পথে মারা গিয়েছিল। অনেক কাছিমের ডিম সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে ফুটিয়ে সাগরে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তবে ওই ডিম পাড়ার সময়েও ব্যাপক মৃত্যু ঘটেছিল। এই প্রাকৃতিক বিপদগুলো প্রতিবছর বাড়ছে, যা কিনা জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের পরিবেশগত ক্ষতির ফলস্বরূপ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রচেষ্টা এবং চ্যালেঞ্জ
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে গিয়ে কাছিমদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তবে, এই সব পদক্ষেপের পরও, দীর্ঘমেয়াদে যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তবে সামুদ্রিক কাছিমদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক আওসাফুল ইসলাম জানান, সৈকতে প্রচুর রিসোর্টের আলো এবং পর্যটকদের কুকুরসহ নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তারপরও, তারা আশাবাদী যে, কিছু সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট ক্ষতি
কক্সবাজারের এই চিত্র শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৃহত্তর পরিবেশগত সংকটের অংশ। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত পর্যটন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন যে ধরনের বিপদ সৃষ্টি করছে, তা আমাদের মনে রাখতে হবে। পরিবেশগত সচেতনতা এবং ব্যবস্থা না নিলে, আমরা হয়তো একদিন দেখতে পাবো যে, কাছিমদের মতো জীববৈচিত্র্যও কেবল কাগজে-কলমে থাকবে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কী করা যেতে পারে?
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায় কাজ করছেন। তারা আশাবাদী যে, কিছু সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। তবে, একথাও সত্য, যে যদি আমরা আমাদের পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল না হই, তাহলে হয়তো সামুদ্রিক কাছিমের মতো অনেক প্রাকৃতিক ঐতিহ্য একদিন হারিয়ে যাবে।
এটি আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা, যে আমাদের পরিবেশের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত পর্যটন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে। তবেই আমরা নিশ্চিত করতে পারব যে, কাছিমের মতো প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।