২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস ঢাকার বায়ুদূষণের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ অধ্যায় হয়ে থাকবে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর গবেষণা অনুযায়ী, এই মাস ছিল গত ৯ বছরে সবচেয়ে দূষিত। শুধু ১৪ ডিসেম্বর দিনটিই নয়, পুরো মাসজুড়েই বায়ুমানের অবস্থা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। ঢাকার বায়ুদূষণের রেকর্ড
৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত মাস
গত বছরের ডিসেম্বরে বায়ুর গড় মান ছিল ২৮৮, যা ২০১৬ সালের তুলনায় অনেক বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪ ডিসেম্বর রাত ১১টায় ঢাকার বায়ুমান ৮৮০-এ পৌঁছায়। এটি এমন একটি সংখ্যা, যা গত ৯ বছরে কখনো দেখা যায়নি। পুরো মাসে ১১ দিন ধরে বায়ুর মান ছিল ‘দুর্যোগপূর্ণ’ অবস্থায়, যা আগের ৮ বছরের তুলনায় বহুগুণ বেশি।
ক্যাপসের তথ্য অনুসারে, ডিসেম্বর মাসে ঢাকার বায়ুর মান সব সময়েই খারাপ থাকে। তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই মান আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। ২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ডিসেম্বর মাসে বায়ুর গড় মান ছিল ২১৯ দশমিক ৫৪। কিন্তু ২০২৪ সালে এই মান ৩১ শতাংশ বেড়ে যায়। ঢাকার বায়ুদূষণের রেকর্ড
দূষণের কারণ ও উৎস
ঢাকার বায়ুদূষণের পেছনে রয়েছে কয়েকটি সুস্পষ্ট কারণ। প্রধানত ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, কলকারখানার ধোঁয়া, রাস্তার ধুলাবালি, এবং যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো বায়ুদূষণের প্রধান উৎস। শহরে চলমান অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ এবং এসব কাজ থেকে তৈরি হওয়া ধুলাবালি পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানিয়েছেন, এসব দূষণের উৎস বন্ধে প্রকল্পের প্রয়োজন নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর তদারকি যথেষ্ট। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই তৎপরতার অভাব প্রকট।
স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়াবহতা
বায়ুদূষণের ফলে ঢাকার নাগরিকরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। ডিসেম্বর মাসে আগারগাঁও টিবি হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৪১০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এবং অন্যান্য ফুসফুসজনিত রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেছেন, ‘ডিসেম্বর মাসের ভয়ানক দূষণের প্রতিফলন আমরা আমাদের হাসপাতালে দেখেছি। দূষণ বাড়ার সঙ্গে রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।’
বায়ুমানের এত খারাপ অবস্থা শিশু, বয়স্ক এবং অসুস্থ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করে। দীর্ঘমেয়াদে এই ধূলিকণা ফুসফুস এবং হৃদরোগের কারণ হতে পারে।
কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম ও সমালোচনা
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে নাগরিক ও বিশেষজ্ঞ মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। পরিবেশবিদ ইকবাল হাবিব বলেছেন, ‘বায়ুদূষণ কমাতে বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটি শুধু প্রতারণা।’
অন্যদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক জানিয়েছেন, ‘নভেম্বরে অভিযান কম হওয়ায় ইটভাটার দূষণ বাড়তে পেরেছে। রাস্তার আশপাশে বর্জ্য পোড়ানো এখনও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ঢাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে আরও সময় লাগবে।’
বায়ুদূষণ কমাতে সম্ভাব্য উদ্যোগ
বায়ুদূষণ কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। কার্যকর আইন প্রয়োগ, দূষণমুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ, এবং নির্মাণকাজে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করাও দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপসংহার
বায়ুদূষণ এখন শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি বড় স্বাস্থ্য সংকট। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। ঢাকার বায়ু মান উন্নত করার জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকারের কার্যকরী উদ্যোগ, নাগরিক সচেতনতা, এবং পরিবেশবাদী সংস্থার তৎপরতায় এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
আপনার মতামত কী? ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আপনি কী পদক্ষেপ আশা করেন? আমাদের সাথে শেয়ার করুন এবং পরিবেশ সম্পর্কিত আরও তথ্য পেতে পেজ সাবস্ক্রাইব করুন।