প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারানোর শঙ্কা
কুমিল্লার নদ-নদী দখল, দূষণ এবং অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর অবস্থান আজ বিলীনের পথে, যা জেলার পরিবেশ এবং স্থানীয় জীবিকা নির্বাহের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এবং স্থানীয় কৃষি ও মৎস্য সম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কুমিল্লার নদীগুলো সংকটে
গোমতী নদীর বর্তমান চিত্র
গোমতী নদী একসময় কুমিল্লার প্রধান নদীগুলোর মধ্যে একটি ছিল। এই নদীটি এখন সংকুচিত হয়ে পড়েছে, যেখানে আগে প্রবাহমান ছিল বিস্তীর্ণ জলরাশি। এর পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা, যা সাম্প্রতিক বন্যার সময় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। বন্যার পানি নামার পর দখলের প্রবণতা আবার ফিরে আসে। নদীর তীরের মাটি কেটে নেওয়া এবং বালু উত্তোলনের কারণে নদীর তীর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
পুরানো গোমতীর হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
পুরানো গোমতী নদী কুমিল্লার ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু দখলদারদের দৌরাত্ম্যে এটি প্রায় একটি মরা খালে রূপান্তরিত হয়েছে। নদীর দুই পাড় দখল করে ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট নির্মাণ করা হয়েছে। ময়লা আবর্জনা এবং কচুরিপানায় ঢেকে থাকা এই নদীর জল এখন ব্যবহারের অনুপযুক্ত। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় এই নদীটির ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লার নদীগুলো সংকটে
ডাকাতিয়া নদীর কৃষিতে অবদান
ডাকাতিয়া নদী একসময় কুমিল্লার কৃষি উন্নয়নের মেরুদণ্ড ছিল। দক্ষিণ কুমিল্লার বিস্তীর্ণ এলাকা এই নদীর পানির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু দখল এবং দূষণের কারণে এর সীমানা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। লাকসামের দৌলতগঞ্জ এলাকায় নদীর দুই পাড় দখল করে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। নদীতে পলি জমে চর জেগে ওঠায় এর জলপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।
ছোট নদীগুলোর অস্তিত্ব সংকট
ক্ষিরাই, কালা ডুমুর, মধুকুপি এবং ঘুংঘুরসহ ছোট নদীগুলোও বিপদে পড়েছে। অপরিকল্পিত নির্মাণ এবং পলি জমার ফলে এসব নদীর প্রস্থ কমে গেছে। কোনো কোনো নদী এখন মাটি ভরাট করে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে পরিবেশ এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্য চরম সংকটে পড়েছে। ঘুংঘুর নদীর ২০ কিলোমিটারের বেশি অংশ দখল হয়ে গেছে, যেখানে একসময় খরস্রোতা প্রবাহ ছিল।
প্রশাসনিক ভূমিকার গুরুত্ব
স্থানীয় প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন ধীরগতিতে চলছে। অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হলেও তাদের উচ্ছেদ কার্যক্রম এখনও পর্যাপ্ত নয়। নদীগুলো পুনরুজ্জীবিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে খনন এবং বাঁধ সংস্কার প্রয়োজন। এছাড়া, দখলদারিত্ব বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।
পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ
পরিবেশবাদীদের মতে, নদীগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি প্রশাসনিক অবহেলার ফল। সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলে এই সংকট এড়ানো যেত। তারা বিশ্বাস করেন, জনসচেতনতা বাড়ানো এবং শক্তিশালী প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে নদী রক্ষা করা সম্ভব। পরিবেশ রক্ষায় সকল পক্ষকে একসাথে কাজ করতে হবে।
সমাধানের পথ
কুমিল্লার নদ-নদীগুলো রক্ষার জন্য সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। প্রথমে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে হবে। প্রশাসনের যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনো নতুন দখলদারিত্ব ঘটতে না পারে। নদীগুলোর খনন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে, বিশেষ করে যেখানে পলি জমে নদীর প্রস্থ সংকুচিত হয়েছে।
নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে বাঁধ সংস্কারের কাজ অবিলম্বে শুরু করা দরকার। জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নদীর পানি দূষণমুক্ত রাখতে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধে কড়া নজরদারি প্রয়োজন।
স্থানীয় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। স্কুল, কলেজ এবং স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করলে মানুষ নদী রক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন পরিবেশগত সংগঠনকে একসাথে কাজ করতে হবে, যাতে এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় একটি সামগ্রিক উদ্যোগ নেওয়া যায়।
নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করা যেতে পারে। এতে মাটি ক্ষয় রোধ হবে এবং নদীর তীর আরও মজবুত হবে। উন্নত সেচ ব্যবস্থা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদী থেকে জল উত্তোলনের প্রভাব কমানো যেতে পারে। এ ছাড়া, নতুন প্রকল্প গ্রহণের আগে সমীক্ষা এবং পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণ বাধ্যতামূলক করা উচিত।
সবশেষে, প্রশাসনিক ও সামাজিক উদ্যোগের সমন্বয়ে নদ-নদীগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব। যদি আমরা এখনই উদ্যোগী না হই, তাহলে কুমিল্লার নদ-নদীগুলো কেবল ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে। সময় এসেছে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের মাধ্যমে এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার।
উপসংহার
নদ-নদীগুলো শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়; এটি আমাদের সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং জীবিকার অংশ। দখল এবং দূষণ রোধে এখনই উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি বড় পরিবেশগত সংকটের মুখোমুখি হবে। নদী বাঁচানোর দায়িত্ব কেবল প্রশাসনের নয়, বরং আমাদের সবার। আসুন, একসাথে এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় উদ্যোগী হই এবং একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করি।