নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে মাছের সংকট
বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলা, বিশেষ করে মদন, মোহনগঞ্জ এবং খালিয়াজুরী উপজেলা একসময় দেশের অন্যতম মাছের ভাণ্ডার ছিল। সেখানকার নদী, খাল-বিল এবং হাওরগুলো ছিল দেশীয় মাছের জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা বছরে হাজার হাজার মেট্রিক টন মাছ আহরণ করতেন, যা জেলার মানুষের জন্য ছিল একটি প্রধান জীবিকা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠানো হতো। তবে এখন পরিস্থিতি একেবারে বিপরীত। দিন দিন দেশীয় মাছের প্রজাতি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে এবং এ কারণে এলাকার মৎস্যজীবী পরিবারগুলো চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
মাছের সংকটের প্রকৃত কারণ
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাছের এই সংকটের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, বর্ষাকালে হাওর, নদী এবং খাল-বিলগুলোর মাছের প্রজনন মৌসুমে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। কারেন্ট জাল, ভরজাল, ম্যাজিক জাল, চায়না দুয়ারি জাল ইত্যাদি যেমন মাছের পোনা নিধন করে, তেমনি প্রাকৃতিকভাবে মাছের প্রজননেও বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া, শুকনো মৌসুমে বিশেষত বোরো আবাদে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে অনেক মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিষাক্ত হয়ে পড়ছে।
এ ছাড়া, কিছু অসাধু মৎস্যজীবীরা বর্ষা মৌসুমে গ্যাস ট্যাবলেট প্রয়োগ করে নির্বিচারে মাছ ধরছেন। ফলে মাছের বংশবিস্তার থেমে যাচ্ছে এবং অনেক প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, হাওর, নদী এবং খাল-বিলগুলো বর্তমানে প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় সাধারণ মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অধিকারও সীমিত হয়ে গেছে।
মৎস্যজীবীদের জীবনযাপন সংকটে
নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চলে মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রা বর্তমানে চরম সংকটের মুখে পড়েছে। এক সময়, যারা নদী, খাল-বিল এবং হাওর থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা এখন মাছের অভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন। দেশীয় মাছের প্রাপ্তি কমে যাওয়ায়, মৎস্যজীবীরা তাদের পুরানো পেশা থেকে সরে এসে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। কিছু মৎস্যজীবী কৃষিকাজে, আবার কিছু পুকুরে মাছ চাষের কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন, তবে তাদের আয়ের তুলনা আগের মতো হয়নি।
জেলার বিভিন্ন এলাকার জলাশয়গুলোতে মাছ ধরার সুযোগ কমে যাওয়ায় মৎস্যজীবীদের জীবিকা নির্বাহে বেগ পেতে হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, তারা মাছ ধরতে গিয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও কোনো মাছ পান না। এভাবে তাদের পেশাগত জীবন আরো কঠিন হয়ে উঠছে। এমনকি কিছু পরিবার অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, কারণ মাছ ধরাই তাদের প্রধান আয়ের উৎস ছিল। মাছের অভাব এবং বাজারে দাম বাড়ানোর ফলে স্থানীয় জনগণের খাদ্য নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
পরিবেশগত প্রভাব
দেশীয় মাছের সংকট শুধুমাত্র মৎস্যজীবীদের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এটি পরিবেশগতভাবে আরও বৃহত্তর প্রভাব ফেলছে। হাওর, নদী ও খাল-বিলগুলো যেগুলি এক সময় জীববৈচিত্র্যের জন্য সমৃদ্ধ ছিল, বর্তমানে তা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মৎস্যজীবীদের দ্বারা নিষিদ্ধ জাল এবং বিষাক্ত উপাদান ব্যবহারের ফলে জলজ প্রাণীদের প্রাকৃতিক বাসস্থান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষ করে কীটনাশক ও রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার জলাশয়ে বিষাক্ততা সৃষ্টি করছে, যার ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র এবং বাসস্থানের জন্য উপযোগী পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে এবং অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এছাড়া, জলাশয়গুলোতে জমে থাকা অতিরিক্ত পানি বা ক্ষতিকর উপাদানগুলো পরবর্তীতে বৃহত্তর পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন পানির মানের অবনতি, ভূমিক্ষয় এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রের অস্থিরতা।
এটি শুধুমাত্র মৎস্যসম্পদের জন্যই সমস্যা নয়, বরং পুরো অঞ্চলটির জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যও হুমকির মুখে পড়ছে। হাওরাঞ্চলের এ ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে ভবিষ্যতে খাদ্য সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা বাড়তে পারে।
পুকুরের মাছের দখল বৃদ্ধি
হাওর, নদী ও বিলের মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাজারে পুকুরে চাষ করা মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে যেখানে দেশীয় মাছের প্রাপ্যতা কম, সেখানে অন্যদিকে পুকুরের মাছের দাম বেড়ে গেছে। এই বৃদ্ধি পুকুরের মাছের দখলও আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় বাজারে মাছের প্রাপ্যতা সীমিত হয়ে পড়ছে, এবং জনগণের জন্য ভালো মাছ কিনতে চড়া দাম দিতে হচ্ছে।
পুকুরে চাষ করা মাছের জন্য ক্রমশ জমি দখলের প্রবণতা দেখা দিয়েছে। যেহেতু পুকুরে চাষ করা মাছ অধিক লাভজনক হয়ে উঠেছে, সেহেতু এটি কৃষি জমি এবং জলাশয়ের দখল বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এটি প্রাকৃতিক জলাশয়ের ক্ষতি ঘটাচ্ছে এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রের প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। পুকুরের মাছের দখল বৃদ্ধি অবশ্যই খাদ্য সুরক্ষার জন্য অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করবে, কারণ এটি দেশীয় মাছের উৎপাদন কমিয়ে দেবে এবং মানুষের মাছের পছন্দের বিষয়েও প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া, এই পরিস্থিতি স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকা নির্বাহের উপায় সংকুচিত করে, কারণ মাছের প্রকৃত প্রজনন ক্ষেত্রগুলো তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের পরিবর্তন অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য অভাব ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে।
পরিবেশগত প্রভাব
দেশীয় মাছের সংকটের মূল কারণগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এটি সরাসরি পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে। হাওরাঞ্চল, যেখানে এক সময় প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেত, সেখানে বর্তমানে মাছের প্রাকৃতিক বাসস্থান বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য দেশীয় মাছের অস্তিত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
তবে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবীর জানান, কিছু মাছ যেমন টেংরা, শিং, কই মাছ কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পাশাপাশি, মৎস্য গবেষকরা রানি মাছের প্রজননও পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় উদ্যোগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি
মৎস্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্থানীয় জলাশয়গুলোতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নিষিদ্ধ জাল উদ্ধার এবং জরিমানা করা হচ্ছে। তবে, এ কাজগুলো যথেষ্ট নয়। জলাশয়গুলো এবং মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলোকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, যা শুধুমাত্র সরকারের উদ্যোগে সম্ভব নয়, জনগণকেও এর অংশীদার হতে হবে।
পাঠকদের জন্য বার্তা: পরিবেশ রক্ষা এবং সচেতনতা
এখন সময় এসেছে আমাদের পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সক্রিয় হওয়ার। স্থানীয় মৎস্যজীবী, পরিবেশবিদ এবং সাধারণ জনগণের যৌথ উদ্যোগে যদি আমরা পরিবেশের প্রতি যত্নবান হই, তবে দেশীয় মাছ এবং জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। দেশীয় মাছের উৎপাদন এবং প্রজনন ক্ষেত্রগুলো রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আমাদের সচেতনতা এবং পরিবেশ সম্মত আচরণই এই সংকটের সমাধান হতে পারে।