চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম সাত দিনে বাংলাদেশে দুবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ৩ জানুয়ারি প্রথম ভূমিকম্পটি ছিল মাঝারি মাত্রার, যার উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের হোমালিন। আজকের ভূমিকম্পটি চীনের জিজাং এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে তীব্রতর আকার ধারণ করেছে। ভূমিকম্প অনুভূত
এই ভূমিকম্পগুলো বাংলাদেশের ভূগোলগত অবস্থানের কারণে তেমন কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করেনি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর জানান, এত দূরে উৎপন্ন হওয়া ভূমিকম্পগুলো বাংলাদেশে কেবলমাত্র কম্পন সৃষ্টি করেছে, তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে আজকের ভূমিকম্পটি রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ১ মাত্রার হওয়ায় এর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশে।
টেকটোনিক প্লেট ও ভূমিকম্পের প্রভাব
পৃথিবীর পৃষ্ঠতলে টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংঘর্ষ থেকেই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। যখন প্লেটগুলো একে-অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন সৃষ্ট শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই শক্তি যদি যথেষ্ট হয়, তবে পৃথিবীর উপরিভাগে কাঁপুনি সৃষ্টি হয়, যা ভূমিকম্প হিসাবে পরিচিত।
আজকের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের উত্তর প্রান্তে, যেখানে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত বড় বড় চ্যুতি রয়েছে। রুবায়েত কবীরের মতে, এই এলাকা এবং মিয়ানমার ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়ায় মাঝেমধ্যেই এ ধরনের ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্প অনুভূত
ভূমিকম্পের পরিবেশগত দিক
ভূমিকম্পের প্রভাব কেবল ভূমিকম্পের সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত পরিবর্তনেরও কারণ হতে পারে। সাধারণত বড় মাত্রার ভূমিকম্পের পর যে পরিবেশগত পরিবর্তনগুলো দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ভূমি পরিবর্তন: ভূমিকম্পের সময় ভূগর্ভস্থ চ্যুতির কারণে ভূমির উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা। এতে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস এবং সমতল এলাকায় মাটির নিচের স্তর পরিবর্তনের ঝুঁকি থাকে। এই পরিবর্তন ফসলি জমির উর্বরতা এবং গৃহস্থালির জন্য ব্যবহৃত জমির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
- জলাশয় সৃষ্টি ও পরিবর্তন: ভূমিকম্পের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি প্রবাহের পথ পরিবর্তিত হতে পারে, যা নতুন জলাশয় সৃষ্টি বা বিদ্যমান জলাশয়ের পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যেমন মিঠাপানির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া।
- ভূগর্ভস্থ জলের স্তরের পরিবর্তন: ভূমিকম্পের কারণে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর উপরে উঠে আসতে পারে বা নিচে নেমে যেতে পারে। এর ফলে স্থানীয় কৃষি ও পানীয় জলের সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে। বিশেষত, ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকায় এই পরিবর্তন জনস্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
- উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রভাব: ভূমিকম্পের কারণে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষত, বনাঞ্চলে ভূমিকম্পের প্রভাব সরাসরি গাছপালা এবং বন্যপ্রাণীর বাসস্থানে বিপর্যয় ঘটায়। এর ফলে কিছু প্রজাতি স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয় বা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে।
সতর্কতার প্রয়োজন
ভূমিকম্পের পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলায় সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো বিশেষ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা উচিত:
- ভূমিকম্প পূর্বাভাস ও মনিটরিং: ভূমিকম্প পূর্বাভাস প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং নির্ভুল মনিটরিং ব্যবস্থা বাড়ানো প্রয়োজন। এর ফলে ভূমিকম্পের আগে যথাযথ সতর্কতা প্রদান সম্ভব হবে, যা প্রাণহানি এবং সম্পদহানি কমাতে সহায়ক হবে।
- প্রতিরোধমূলক অবকাঠামো উন্নয়ন: ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, হাসপাতাল, স্কুল এবং বাসস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের মধ্যে ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও সেমিনার আয়োজন করা জরুরি। কীভাবে ভূমিকম্পের সময় নিরাপদ থাকা যায় এবং পরবর্তী সময়ে করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
- প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ: ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকায় প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে বিশেষ নজর দিতে হবে। এর মধ্যে বনাঞ্চল পুনঃস্থাপন, নদী ও জলাশয়ের প্রাকৃতিক প্রবাহ বজায় রাখা, এবং ভূগর্ভস্থ জলস্তর সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত।
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা: একটি সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, যাতে ভূমিকম্পের পরে দ্রুত ত্রাণ কার্যক্রম চালানো যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পুনর্বাসন কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন হয়।
উপসংহার
এক সপ্তাহে দুবার ভূমিকম্প আমাদের জন্য সতর্ক সংকেত। পরিবেশের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। আমাদের নিজেদের প্রস্তুত করা প্রয়োজন ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য।
ভূমিকম্পের বিষয়ে আরও তথ্য পেতে এবং পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আপডেট থাকতে আমাদের ওয়েবসাইট সাবস্ক্রাইব করুন। আপনার মতামত জানাতে মন্তব্য করতে ভুলবেন না।