দেশের মাঝখানে, সারিয়াকান্দি নদীপারের বাসিন্দারা এক ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন: নদী ভাঙ্গন। যেমনটি জলবায়ু পরিবর্তন প্রবল হচ্ছে, তেমনি যমুনা নদীর অস্থিতিশীল গতিপথ অঞ্চলটির জনগণ, কৃষি জমি এবং কাঠামোকে আরও ধ্বংসাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। সারিয়াকান্দির সাতটি গ্রাম এখন নদী ভাঙ্গনের হুমকিতে আছেন, যারা প্রতিদিন আতঙ্কে এবং উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন।
নদী ভাঙ্গনের বৃদ্ধি: এক ক্রমবর্ধমান হুমকি
সারিয়াকান্দির নদীভাঙ্গন নতুন কোনো ঘটনা নয়। এই অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে নদী তীর ভাঙ্গনের ঘটনা ঘটে আসছে। তবে, গত বছরের ভয়াবহ বন্যা পরবর্তী সময়ে এ সমস্যা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। গত বর্ষা মৌসুমে, ৫০০টিরও বেশি বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে এবং প্রায় কয়েক শতক জমি যমুনার কাছে হারিয়ে গেছে।
বর্তমানে গোদাখালি পয়েন্টে নদী বাঁধ থেকে ২০০ মিটার দূরে চলে এসেছে, যেখানে নদী ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে আরও বাড়ি এবং জমি ভেসে যাবে। স্থানীয় জনগণ বর্তমানে আতঙ্কিত, যদি ভাঙ্গন চলতে থাকে, তাহলে তাদের ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাবে এবং শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া সদর, ধুনটসহ অন্যান্য এলাকায় ব্যাপক ফসলের ক্ষতি হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনে নদী ভাঙ্গনের প্রসার
যমুনা নদী এবং তার ভাঙ্গন প্রক্রিয়া কেবল প্রাকৃতিক ঘটনা নয়; এগুলি জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা আরও তীব্র হয়েছে। এই অঞ্চলে আবহাওয়ার ধারা পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টি এবং নদীর প্রবাহে পরিবর্তন এ সমস্যাকে আরও জটিল করেছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বন্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া। উজানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত নদীকে অস্বাভাবিকভাবে ফুলিয়ে তোলে, যার ফলে তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দেয়। এই পরিবর্তিত পরিবেশ যমুনার গতিপথকে আরও অস্থিতিশীল করেছে, যার কারণে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ কঠিন হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি ঘটতে থাকার সম্ভাবনা আরও বেড়েছে।
অবৈধ বালু উত্তোলন: প্রধান কারণ
এই অঞ্চলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। গত কয়েক বছরে, যমুনা নদীর বিভিন্ন চর বালু উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলির হাতে বিক্রি করা হয়েছে। তবে, এই কোম্পানিগুলি নিয়মকানুন ভঙ্গ করে এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালু উত্তোলন করায় নদীর গতিপথ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।
বালু উত্তোলনের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় আরও বেশি নদী ভাঙ্গন হচ্ছে, ফলে একের পর এক গ্রাম এবং জনপদ নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, বন্যার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী ভাঙ্গন রোধে জরুরি ভিত্তিতে কিছু বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে, কিন্তু এতে কার্যকরী কোনো পরিবর্তন আসে না।
স্থানীয় জনগণের দাবি: দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান
স্থানীয় বাসিন্দারা, যারা ইতিমধ্যেই তাদের বাড়িঘর নদীতে হারিয়েছেন, এখন আরো দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। তারা দাবি করছেন, বছরশেষে তাদের দুর্দশা শেষ হবে না যদি তীর রক্ষা বাঁধের কাজ দ্রুত না হয়।
এছাড়া, তারা আরও দাবি করেছেন যে বালু উত্তোলন বন্ধ করা উচিত, কারণ এটি নদীর গতিপথ আরও দ্রুত পরিবর্তন করছে এবং গ্রামগুলোকে বিপদের মধ্যে ফেলছে।
সরকারী প্রতিক্রিয়া: যথেষ্ট কি?
সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং এই সংকটের গুরুতরতা স্বীকার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, যে স্থানে ভাঙ্গন চলছে সেখানে তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। তবে, এই ধরনের প্রকল্পগুলো প্রায়ই দেরিতে শুরু হয় এবং পুনরায় নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।
এছাড়া, ভাঙ্গন রোধে ৫০ কোটি টাকার একটি ডিপিপি জমা দেওয়া হয়েছে, যা অনুমোদিত হলে দ্রুত কাজ শুরু হবে। তবে শুধু স্থায়ী বাঁধ তৈরি করলেই সমস্যা সমাধান হবে না। এর জন্য আরও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন, যেমন বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মোকাবিলায় সামগ্রিক ব্যবস্থা।
ভবিষ্যতের পথ: নদী ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী সমাধান
যমুনা নদী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারিয়াকান্দির নদী ভাঙ্গন পরিস্থিতি ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। অবৈধ বালু উত্তোলন এবং অনিয়মিত আবহাওয়া মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদী, টেকসই সমাধান প্রয়োজন। যত দ্রুত সম্ভব নদী ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
এছাড়া, স্থানীয় জনগণকে প্রকল্পের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, কারণ তারা সবার আগে ভাঙ্গনের প্রভাব অনুভব করে। অবৈধ বালু উত্তোলন এবং নদী রক্ষায় তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
শেষ কথা
সারিয়াকান্দির নদী ভাঙ্গন সংকট জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ মানবিক কার্যক্রম এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর সমন্বয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই সংকট সমাধানে সরকার এবং স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একমাত্র স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে মোকাবিলা করতে, নদীভাঙ্গন রোধে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি, জনসাধারণ এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সহযোগিতা তৈরি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে নদী ভাঙ্গন আরো বিস্তার না পায়।