বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এক ক্রমবর্ধমান উদ্বেগজনক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং এই পরিবর্তন শুধু মানুষের জীবনকেই বিপর্যস্ত করছে না, বরং পৃথিবীর বন্যপ্রাণীও এর তীব্র প্রভাব অনুভব করছে। বাংলাদেশে, কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের হস্তীশাবকগুলো এর বড় উদাহরণ। তিনটি হস্তীশাবক যে মানবিক স্নেহ এবং আস্থা নিয়ে বেড়ে উঠছে, তা শুধুমাত্র প্রাণী সংরক্ষণে মানুষের ইতিবাচক ভূমিকার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত নয়, বরং জলবায়ু সংকটের কুপ্রভাবের মোকাবিলায় মানবজাতির এক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। সাফারি পার্কে বন্য হস্তীশাবকগুলোর লালনপালন
হস্তীশাবক উদ্ধার: এক আশ্চর্য ঘটনাপঞ্জি
৪ জানুয়ারি, ২০২৩—কক্সবাজারের টেকনাফের গহিন পাহাড়ে এক মা হাতি প্রসব করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তবে সবার ভাগ্য ভালো, তার একমাত্র শাবকটি বেঁচে যায়। বন বিভাগ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে শাবকটিকে উদ্ধার করে এবং তা নিয়ে আসা হয় ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে। এই ঘটনাটি শুধু একটি অবিশ্বাস্য উদ্ধার ঘটনা নয়, এটি সেই বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যপ্রাণী নিজেদের প্রাকৃতিক বাসস্থানে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। সাফারি পার্কে বন্য হস্তীশাবকগুলোর লালনপালন
এরপর, পার্কের অভ্যন্তরে আরও দুটি হস্তীশাবক উদ্ধার করা হয়, একটি নাম রাখা হয়েছে বীর বাহাদুর এবং অন্যটির নাম যমুনা। তাদের জীবন সংগ্রাম এবং মানুষের স্নেহে বেড়ে ওঠার গল্পটি এক অনুপ্রেরণার মতো, যেখানে মানুষের স্নেহ এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা একত্রিত হয়।
মানবিক স্নেহে বেড়ে উঠছে হস্তীশাবক
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে হস্তীশাবকগুলোর প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্য ৪০ একর গর্জনবনের মাঝে একটি বন্যপ্রাণী হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে, যেখানে শাবকগুলো নিয়মিত খাবার, স্নেহ এবং চিকিৎসা পাচ্ছে। এসব শাবক যে মানুষের ভালোবাসায় বেড়ে উঠছে, তা দেখতে বেশ অভিভূতকারী। তাদের মধ্যে শাবক বীর বাহাদুর এখন পুরোপুরি সুস্থ এবং প্রাণবন্ত। আর যমুনা, যে কিনা মানুষের কাছে বড় হয়ে উঠছে, অন্য হাতির সাথে মিশতে পারছে, এটা সেই ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বের নিদর্শন যা এই প্রাণীদের নতুন জীবন উপহার দিয়েছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে টেকসই প্রচেষ্টা
এখন প্রশ্ন ওঠে, এমন প্রাণীদের প্রকৃত পরিবেশে ফিরে যাওয়ার জন্য কি আমাদের কিছু করণীয় নেই? আসলে, এই সাফারি পার্কের কার্যক্রম শুধু প্রাণী সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেয় না, বরং এটি প্রমাণ করে দেয় যে জলবায়ু সংকটের সময়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য মানুষের প্রচেষ্টা কতটা প্রয়োজন। বনভূমির ক্ষতি, আবহাওয়ার পরিবর্তন, এবং প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যেখানে বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়ছে।
পশুদের বিশেষ যত্ন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা
হস্তীশাবকগুলোর বিশেষ পরিচর্যা এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনাও খুবই চিত্তাকর্ষক। যেমন, বীর বাহাদুর যখন প্রথম আসে, তখন তার অবস্থা ছিল খুবই সংকটাপন্ন। তবে এখন সে দিনে দিনে বড় হচ্ছে এবং দৌড়ঝাঁপ করছে। যমুনা, যাকে প্রথমে দেখা যেত একদম মানবিক স্নেহে বেড়ে উঠতে, সে এখন অন্য হাতিদের সাথে মিশে খেলে। তবে তাদের খাদ্য ব্যবস্থাও অত্যন্ত বিশেষ: শুরুতে দুধ, কলা, শসা, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি খাওয়া হলেও, এখন তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং ঘাস, শসা, কলাগাছ, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি খাচ্ছে।
পার্কের গুরুত্ব: সচেতনতা এবং টিকিট সংগ্রহ
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কটি এক বৃহৎ উদ্যোগ, যেখানে দেশীয় এবং বিদেশী বন্যপ্রাণী একত্রে রক্ষা পেয়ে থাকে। এক সময় এটি ছিল হরিণ প্রজনন কেন্দ্র, কিন্তু বর্তমানে এটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম। সেখানে সিংহ, বাঘ, হাতি, ময়ূর, জলহস্তীসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১টি প্রাণী রয়েছে। দর্শকদের জন্য পার্কটি উন্মুক্ত, যেখানে তারা বন্যপ্রাণী দেখে পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে বন্যপ্রাণী এবং পরিবেশকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তার একটি উদাহরণ আমরা সাফারি পার্কের এই হস্তীশাবকদের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। যদি এসব প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ রক্ষা করা না যায়, তবে তাদের অস্তিত্বকেও হুমকির মধ্যে ফেলা হবে। তবে সাফারি পার্কের কর্মীরা দিন রাত একাকার হয়ে এসব প্রাণীকে সুস্থ ও সবল করে তুলতে চেষ্টা করছে, যা আমাদের সকলের জন্য এক বড় শিক্ষা।
কীভাবে আপনিও সহায়তা করতে পারেন?
আপনি কী জানেন, আপনি কীভাবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়াসে অংশ নিতে পারেন? আপনার সচেতনতা এবং উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। বন্যপ্রাণী রক্ষায় পার্কের পাশে দাঁড়ান, পরিবেশ রক্ষার জন্য সচেতনতা ছড়িয়ে দিন এবং যেকোনো ধরনের উদ্যোগে সহায়তা করুন।
Call to Action: আপনার মতামত কী? বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আপনি কীভাবে অংশ নিতে চান? মন্তব্যে আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না এবং পরিবেশ সচেতনতায় আমাদের সাথে যোগ দিন!