বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম একটি বড় পরিবেশগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় চলছে একাধিক অবৈধ ইটভাটা, যেগুলোর কারণে শুধু পরিবেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, মানুষের স্বাস্থ্যেও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত প্রচেষ্টার পরও এসব ভাটা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ এর পিছনে রাজনৈতিক সহায়তা রয়েছে। এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ এই অবৈধ কার্যক্রমগুলি দেশের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন করছে। পার্বত্য এলাকায় অবৈধ ইটভাটা
ফাইতংয়ে অবৈধ ইটভাটার বৃদ্ধি
বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি অঞ্চল। তবে এই অঞ্চলে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ৩৬টি ইটভাটা, যেগুলোর অধিকাংশই পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। মাটি কাটার কারণে পাহাড়ের স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আবার বনের কাঠ পোড়ানোর কারণে গাছপালা ধ্বংস হচ্ছে। স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর পরিবেশে ধোঁয়া, ছাই ও ধুলার প্রভাব পড়ছে, যার ফলে শিক্ষার্থীরা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছে। এমনকি বাড়িঘরেও একই রকম ধুলা ও দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
ফাইতংয়ের এমন পরিস্থিতি শুধু এলাকাবাসীকে নয়, দেশের পরিবেশকেও বিপদে ফেলছে। এখানে থাকা অবৈধ ৩৬টি ইটভাটার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান চালালেও সেগুলি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের অভিযান শেষ হওয়ার পরও অনেক ভাটার মালিক আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আবারও কার্যক্রম চালু করে দেয়।
রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণে অবৈধ ইটভাটা
পার্বত্য অঞ্চলের অবৈধ ইটভাটাগুলোর বেশিরভাগই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব ভাটার মালিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ইসলামী এবং স্থানীয় নেতারা রয়েছেন, যাদের কারণে প্রশাসন কার্যকরভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। একাধিকবার আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও, প্রশাসন সঠিকভাবে অভিযান পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ ভাটাগুলো রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যুক্ত।
ইটভাটার পরিবেশগত প্রভাব
অবৈধ ইটভাটাগুলোর কার্যক্রমের পরিবেশগত প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। প্রথমত, বনের কাঠ পোড়ানোর কারণে পরিবেশের জন্য অপরিসীম ক্ষতি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইটভাটাগুলোর কার্বন নিঃসরণ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। একটি ইটভাটায় বছরে ৩৯৪ টন কার্বন, ১,৪৪৪ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড, ৬.৩ টন মিথেন এবং ১০২ টন নাইট্রিক অক্সাইড নিঃসৃত হয়, যা পরিবেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্রীনহাউস গ্যাস বাড়ায়। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের হারও বেড়ে যেতে পারে। পার্বত্য এলাকায় অবৈধ ইটভাটা
তাছাড়া, ইটভাটাগুলোর কারণে মাটি, পানি এবং বাতাসের দূষণও হচ্ছে। বায়ু দূষণের কারণে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, ফুসফুসের রোগ এবং চর্মরোগের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষত, ইটভাটার আশেপাশের এলাকাগুলোতে বসবাসকারী মানুষ এ ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এছাড়া, পানি দূষণের কারণে কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং বনভূমির অবক্ষয়ও হচ্ছে।
অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, পাহাড় বা বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে, আবাসিক এলাকা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু এসব আইন এবং বিধিনিষেধ সত্ত্বেও, প্রশাসন বাধা সৃষ্টি করতে পারছে না, কারণ আইন প্রয়োগের সময় রাজনীতির প্রভাবশালীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন।
এছাড়া, হাইকোর্টের নির্দেশনার পরেও, অনেক ভাটা বন্ধ না হয়ে আবারও চালু হয়ে যায়। আইনজীবী এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলি এর বিরুদ্ধে বারবার মামলা করলেও, সেগুলোর কোনো কার্যকরী ফল পাওয়া যায়নি।
শেষ কথা
এই অবৈধ ইটভাটাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ না করা হলে, ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটবে। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য এই অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদেরও এর বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের সকলের দায়িত্ব, পরিবেশ রক্ষা করা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী রেখে যাওয়া।