একটি খালের অস্তিত্ব বিলুপ্ত, কৃষির অচলাবস্থা
শরীয়তপুরের নড়িয়ায় সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণে ভরাট করা হয়েছে একটি প্রাচীন প্রবহমান খাল। এর ফলে জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে ৩৫০ একর কৃষি জমি, যেখানে একসময় ফসলের সোনালি মৌসুমে ধান আর পাটের হাসি ফুটত। খাল ভরাটের খেসারত
সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রভাবে স্থানীয় কৃষকেরা চাষাবাদ বন্ধ করে বিকল্প পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। গাগ্রীজোড়া ও পাড়াগাঁও এলাকায় এ খাল ভরাটের কারণে শত শত কৃষকের জীবন-জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
পরিবেশগত দিক: নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা
কীর্তিনাশা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালটি ভরাট করায় পানিপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে। বর্ষার পানি জমে কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে। খালের পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক পথ বন্ধ হওয়ায় চারপাশের জমিগুলোতে জমে থাকা পানিতে কচুরিপানা জন্মেছে।
এটি শুধু কৃষি খাতের জন্য নয়, বরং সমগ্র পরিবেশ ব্যবস্থার জন্যই একটি বড় হুমকি। খাল ভরাটের প্রভাব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটেও গভীর হতে পারে, যেখানে প্রবাহমান পানি সংকট আরো জটিল রূপ ধারণ করবে।
কৃষকের আর্তনাদ ও দাপ্তরিক আশ্বাস
গাগ্রীজোড়া এলাকার কৃষক সিরাজ সরদার বা হানিফ কাজীর মতো কৃষকেরা একসময় খালকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন জলাবদ্ধতার কারণে তিন বছর ধরে তাঁরা চাষাবাদ করতে পারছেন না। কৃষকদের দাবি, এই সমস্যা সমাধানে সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় খালের স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল। খাল ভরাটের খেসারত
নশাসন ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিষয়টি স্বীকার করলেও কার্যকর কোনো সমাধান এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ বিকল্প ব্যবস্থার আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
উন্নয়ন বনাম টেকসই পরিবেশ
এ ঘটনা আবারো প্রমাণ করে যে উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশগত দিকগুলো অগ্রাধিকার না পেলে তার পরিণতি ভয়াবহ হয়। উন্নয়ন আর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার সমন্বয় না হলে এর প্রভাব শুধু স্থানীয় নয়, বরং জাতীয় স্তরে পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়াবে।
স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাবের বিস্তারিত বিশ্লেষণ
খাল ভরাটের সমস্যাটি সমাধান করা হলে কেবল কৃষকের জীবন-জীবিকা রক্ষা পাবে না, পাশাপাশি পরিবেশ ও পানির প্রবাহের ভারসাম্যও টিকে থাকবে। তাই নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
১. খালের প্রবাহ পুনরুদ্ধার
খনন কার্যক্রম শুরু করা:
ভরাট হওয়া খালের অংশ খননের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ পুনরায় চালু করতে হবে। এতে জমিতে জমে থাকা জলাবদ্ধতা দূর হবে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। খাল খনন প্রকল্পে স্থানীয় কৃষকদের যুক্ত করে কাজের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে।
জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা:
সড়কের সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় এমন একটি সিস্টেম তৈরি করা উচিত যেখানে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়। পানির গতিপথ ধরে রাখতে কালভার্ট বা আন্ডারপাস সিস্টেম স্থাপন করা যেতে পারে।
২. উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা
ইআইএ (Environmental Impact Assessment) বাধ্যতামূলক করা:
সেতু, সড়ক বা বড় প্রকল্প শুরু করার আগে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর ফলে প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাব আগেই চিহ্নিত করা যাবে এবং তা এড়ানোর জন্য বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা গ্রহণে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ:
উন্নয়ন প্রকল্পের সময় স্থানীয় কৃষক ও বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাঁদের জীবনযাত্রার উপর প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে হবে।
৩. সেতুর সংযোগ সড়কের বিকল্প নকশা গ্রহণ
পরিকল্পনায় টেকসই নকশা তৈরি:
সেতুর সংযোগ সড়কের নকশায় এমন বিকল্প তৈরি করা যেতে পারে যেখানে খালের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়। সড়ক নির্মাণের সময় পর্যাপ্ত ব্রিজ বা কালভার্ট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
সংশোধিত নকশার বাস্তবায়ন:
বর্তমান সংযোগ সড়কটি খালের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেছে। সওজ বিভাগ বিকল্প নকশা তৈরি করে, ভরাট হওয়া অংশ খনন এবং পুনঃসংযোগ স্থাপনের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে।
৪. ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান
আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান:
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান জরুরি। গত তিন বছরের চাষাবাদ বন্ধ থাকার ফলে তাঁদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারকে কৃষি প্রণোদনা দিতে হবে।
বিকল্প কর্মসংস্থান ব্যবস্থা:
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। এর মধ্যে ছোটখাটো উদ্যোগ, মাছ চাষ, বা কৃষি সরঞ্জামের প্রশিক্ষণ প্রদান অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
৫. খাল ও নদী দখলমুক্ত রাখা
দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ:
খাল ও নদীর সংযোগ দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেতুর নির্মাণ কাজে যারা পরিবেশ ও পানিপ্রবাহ উপেক্ষা করেছে, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
জলবায়ু টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন:
সরকারি নীতিমালায় খাল, নদী, এবং জলাশয়ের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ আইন ও প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
উপসংহার
উন্নয়ন প্রয়োজন, তবে তা টেকসই হওয়া উচিত। খালগুলো আমাদের পরিবেশের শিরা-উপশিরার মতো কাজ করে। সেগুলো বন্ধ করে দিলে পরিবেশ আর কৃষি, উভয়ই মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ে।
আপনার মতামত জানান! কীভাবে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব?
আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য সচেতন হোন, সচেতন করুন।
Call to Action: পোস্টটি ভালো লেগেছে? শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত জানাতে মন্তব্য করুন। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিষয়ক এমন আরও বিশ্লেষণ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।