ঢাকার বায়ুদূষণ: বর্তমান চিত্র
ঢাকা শহর বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীগুলোর একটি। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার বায়ুদূষণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ক্যাপস (বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র) এবং আইকিউএয়ার থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, পুরো জানুয়ারিতে ঢাকার বায়ুর মান ছিল “অস্বাস্থ্যকর” বা “দুর্যোগপূর্ণ” পর্যায়ে।
শুকনা মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) দূষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এবারের জানুয়ারিতে ৩১ দিনের মধ্যে ১৬ দিন ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’, আর বাকি ১৫ দিন ছিল ‘অতি অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ’ পর্যায়ে। এমন পরিস্থিতি নগরবাসীর জন্য চরম উদ্বেগজনক।
কেন জানুয়ারি মাসে বায়ুদূষণ এত ভয়াবহ?
১. শুকনা মৌসুমের প্রভাব:
শুকনা মৌসুমে বাতাসে আর্দ্রতার অভাব এবং ধূলিকণার আধিক্যের কারণে দূষণ আরও তীব্র হয়। ঢাকার বায়ুমণ্ডলে ধূলিকণা জমতে থাকে এবং সেগুলো সহজে সরতে পারে না।
২. ইটভাটা ও কলকারখানার ভূমিকা:
ঢাকার আশেপাশের ইটভাটা থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় কারখানার বর্জ্য। এই দুইয়ের সম্মিলনে বায়ুদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
৩. গাড়ির ধোঁয়া:
ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা প্রচুর, যেগুলোর বেশিরভাগই পুরোনো এবং ত্রুটিপূর্ণ। এই যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
৪. নির্মাণকাজ ও ধূলিকণা:
ঢাকার নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে পর্যাপ্ত ধুলা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। ফলে বাতাসে ধূলিকণার ঘনত্ব বেড়ে যায়।
৫. বর্জ্য পোড়ানো:
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে উন্মুক্তভাবে বর্জ্য পোড়ানো একটি সাধারণ ঘটনা। এর ফলে দূষিত গ্যাস এবং ক্ষতিকর কণা বাতাসে মিশে যায়।
জানুয়ারির ভয়াবহ পরিসংখ্যান
১. বায়ুমান সূচক (AQI):
বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫০ হলে তা “ভালো” এবং ৩০০-এর বেশি হলে তা “দুর্যোগপূর্ণ” ধরা হয়। ২২ জানুয়ারি ২০২৫-এ ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ৫১৮ থেকে ৬২২। এমন পরিস্থিতি সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায়নি।
২. গত আট বছরের তুলনা:
ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে বায়ুমানের গড় মান ৩১৮, যা আগের আট বছরের তুলনায় ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি।
- ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গড় মান ছিল ৩০২।
- ২০১৭-২০২৪ সালের গড় ছিল ২৫৫।
- এ থেকে স্পষ্ট, বছরের পর বছর ঢাকার বায়ুমান ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে।
৩. শুকনা মৌসুমের দূষণ:
নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে:
- নভেম্বর ২০২৪: ১০ দশমিক ৩৭% বৃদ্ধি।
- ডিসেম্বর ২০২৪: ৩০ দশমিক ৫৪% বৃদ্ধি।
- জানুয়ারি ২০২৫: দূষণের রেকর্ড ভেঙেছে।
বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকি
১. শিশুদের ওপর প্রভাব:
বায়ুদূষণের কারণে শিশুরা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় বেশি ভোগে। হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়ার ঝুঁকি তাদের ক্ষেত্রে বেশি।
২. বয়স্কদের ঝুঁকি:
বায়ুদূষণ বয়স্কদের হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগে আক্রান্তদের অবস্থার অবনতি ঘটে।
৩. সাধারণ জনগণের জন্য প্রভাব:
শ্বাসকষ্ট, কাশি, চোখ ও গলার জ্বালাপোড়া এখন ঢাকার মানুষের জন্য দৈনন্দিন সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি পরিস্থিতি এমনই থাকে, তবে ভবিষ্যতে শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রকোপ আরও বাড়বে।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কী করা উচিত?
বায়ুদূষণ কমাতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি:
- ইটভাটা আধুনিকীকরণ:
- যেসব ইটভাটা পরিবেশ দূষণ করে, সেগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
- পরিবেশবান্ধব জ্বালানি:
- যানবাহনের ধোঁয়া কমাতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি যেমন সিএনজি বা বৈদ্যুতিক গাড়ি চালু করতে হবে।
- নির্মাণকাজে নিয়ন্ত্রণ:
- নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে ধূলিকণা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা:
- উন্মুক্তভাবে বর্জ্য পোড়ানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
- সবুজায়ন:
- ঢাকায় আরও বেশি সবুজায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। গাছপালা বায়ু পরিশোধনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগ
পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগ: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কী করা হচ্ছে?
পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে এসব উদ্যোগ থেকে দ্রুত ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয় বলে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে।
ইটভাটাগুলো ঢাকার বায়ুদূষণের বড় একটি উৎস। পরিবেশ অধিদপ্তর পুরোনো এবং দূষণকারী ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। অনেক ভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ কমানোর জন্য নতুন নিয়মও প্রণয়ন করা হয়েছে।
যানবাহনের ধোঁয়া বায়ুদূষণে বড় ভূমিকা রাখে। এ সমস্যা মোকাবিলায় পরিবেশ অধিদপ্তর সড়কে অভিযান পরিচালনা করছে। কালো ধোঁয়া ছড়ানো গাড়িগুলোকে জরিমানা করা হচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন বাতিলের মতো কঠোর পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।
নির্মাণস্থল থেকে নির্গত ধূলিকণাও বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ। এ সমস্যা মোকাবিলায় ঢাকার বড় নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নির্মাণস্থলে ধূলিকণা কমানোর জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড আরোপের চেষ্টা চলছে।
উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ানোর বিষয়টিও বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখে। পরিবেশ অধিদপ্তর এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য অভিযান চালাচ্ছে। পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও আধুনিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বায়ুদূষণ মোকাবিলায় গণসচেতনতা বৃদ্ধিও জরুরি। পরিবেশ অধিদপ্তর এ বিষয়ে কাজ করছে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর আইনের প্রয়োগ বাড়াতে কাজ করছে। দূষণ রোধে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপগুলো এখনো যথেষ্ট নয়। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ফলাফল পেতে হলে উদ্যোগগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আরও বেশি ব্যবহার প্রয়োজন।
শেষ কথা
ঢাকায় বায়ুদূষণের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু পরিবেশ নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও একটি বড় হুমকি। দূষণ কমাতে যথাযথ উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হতে পারে।
আমাদের করণীয় কী?
পরিবেশ সুরক্ষায় আপনার অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। বায়ুদূষণ রোধে সচেতন হন এবং অন্যদের সচেতন করুন।
আপনার মতামত দিন: ঢাকায় বায়ুদূষণ কমাতে কী উদ্যোগ নেওয়া উচিত?
সাবস্ক্রাইব করুন এবং পরিবেশ সম্পর্কিত আরও তথ্য জানুন। 🌱