পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর অবৈধ চিড়িয়াখানার প্রভাব
সম্প্রতি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ার কলুকাঠি এলাকায় অবস্থিত মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডমের অনুমোদনহীন মিনি চিড়িয়াখানায় অভিযান চালিয়ে বন অধিদপ্তর ১০ প্রজাতির ৩১টি বন্য প্রাণী উদ্ধার করেছে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চালু থাকা এই চিড়িয়াখানা সরকারি অনুমোদন ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছিল, যা পরিবেশ ও প্রাণীদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছিল। অবৈধ চিড়িয়াখানায় অভিযান
এ ঘটনায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব আবারও সামনে এসেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন আরও অনেক অবৈধ চিড়িয়াখানা রয়েছে, যেখানে প্রাণীদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়। এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে না, বরং বন্য প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেও ব্যাহত করে।
অভিযানের মূল কারণ ও উদ্ধারকৃত প্রাণী
বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্যমতে, এই অবৈধ চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের যথাযথ যত্ন ছাড়াই রাখা হয়েছিল। অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা প্রাণীগুলোর মধ্যে ছিল—
- ১টি ভাল্লুক
- ১টি মিঠা পানির কুমির
- ১টি বার্মিজ অজগর
- ৮টি শজারু
- ১টি মেছো বিড়াল
- ২টি বনবিড়াল
- ২টি কালিম পাখি
- ১০টি ঘুঘু
- ২টি টিয়া
- ৩টি বালিহাঁস
পাখিগুলোকে ঘটনাস্থলেই অবমুক্ত করা হলেও অন্যান্য প্রাণীগুলোকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা শেষে গাজীপুর সাফারি পার্কে তাদের পুনর্বাসন করা হবে।
অবৈধ চিড়িয়াখানার পরিবেশগত বিপদ
অবৈধভাবে পরিচালিত এসব চিড়িয়াখানা বন্য প্রাণীদের অবৈধ বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে। এতে জীববৈচিত্র্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, যা স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। অবৈধ চিড়িয়াখানায় অভিযান
বন্য প্রাণীর অবৈধ দখলের ফলে যেসব পরিবেশগত সমস্যা তৈরি হয়:
- প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় – বন্য প্রাণী প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাদের সংখ্যা কমে গেলে বাস্তুতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
- মানুষ ও প্রাণীদের মধ্যে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে – প্রাণীদের অনিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণ ও প্রদর্শন বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করে।
- বন্য প্রাণীদের আচরণগত পরিবর্তন হয় – খাঁচায় বন্দি থাকার ফলে প্রাণীগুলো তাদের স্বাভাবিক আচরণ হারিয়ে ফেলে, যা তাদের টিকে থাকার সক্ষমতাকে ব্যাহত করে।
বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইন ও প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২ অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বন্য প্রাণী সংগ্রহ, সংরক্ষণ বা প্রদর্শন করতে পারে না। আইন লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে জরিমানা বা কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
তবে, এই আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিভিন্ন স্থানে এখনও অনুমোদনহীন চিড়িয়াখানা ও বন্য প্রাণী বিক্রির ঘটনা ঘটে চলেছে। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অবৈধভাবে বন্য প্রাণী সংগ্রহ ও প্রদর্শনের প্রবণতা কমবে না।
সাধারণ মানুষের করণীয়
আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং বন্য প্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
- অবৈধ চিড়িয়াখানার বিরুদ্ধে সরব হোন – অনুমোদনহীন বন্য প্রাণী প্রদর্শন বা সংরক্ষণের খবর পেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান।
- বন্য প্রাণীদের কেনাবেচা বা বিনোদনের জন্য ব্যবহার বন্ধ করুন – পোষা প্রাণী হিসেবে বন্য প্রাণী সংগ্রহ করা বা বিনোদনের জন্য তাদের ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- প্রকৃতিতে প্রাণীদের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে সহায়তা করুন – বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগকে সমর্থন করুন।
শেষ কথা
শরীয়তপুরের এই অভিযান শুধুমাত্র একটি ছোট ঘটনা নয়, এটি আমাদের দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বড় একটি ইঙ্গিত দেয়। অবৈধ চিড়িয়াখানা ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি, যাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
আপনার এলাকার বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা সম্পর্কে অবগত হলে তা কর্তৃপক্ষের নজরে আনুন। আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা ও কঠোর আইনি প্রয়োগই পারে অবৈধ প্রাণী সংরক্ষণের প্রবণতা বন্ধ করতে।
আপনার মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না! বন্য প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে আপনার ভাবনা কী? মন্তব্য করুন নিচে!