পদ্মার অতীত ও বর্তমান
চার দশক আগেও কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যেত প্রমত্তা পদ্মার গর্জন। এই নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। বৃহত্তর রাজশাহী ও আশপাশের অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল পদ্মা। কিন্তু সেই চিরচেনা রূপ ও জৌলুস আজ হারিয়ে গেছে। বাঁধের ছায়ায় পদ্মার সংকট
ভারতে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মার পানি প্রবাহ ক্রমাগত কমে আসছে। ফলে নদীর আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে, কমেছে গভীরতাও। পদ্মার বুকজুড়ে এখন কেবল বালুচর, যা পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। পদ্মার অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, আর সেই সঙ্গে বেড়েছে তাপমাত্রা।
ফারাক্কা বাঁধ: একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রভাব
ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ১৯৭৭ সালের ১৬ মে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চ হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক পরিবর্তন আসেনি। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, যার ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। পদ্মার পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির সংকটও বেড়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিজমির সেচ ও খাবার পানির সংকট ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে।
পদ্মার দুই পার দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। পানি সংকট ও অনিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ও গভীরতা নষ্ট হচ্ছে, যা পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছে।
গবেষণার আলোকে পদ্মার ভয়াবহ বাস্তবতা
রাজশাহী অঞ্চলের গবেষকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে এখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১২৫ ফুট নিচে নেমে গেছে, ফলে গভীর নলকূপের পানি উঠছে না। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার বরেন্দ্র এলাকায় শীত শেষ না হতেই খাল, বিল, পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বাঁধের ছায়ায় পদ্মার সংকট
একটি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মার আয়তন ৫০ শতাংশ কমেছে। পানির গভীরতা ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, আর পানির প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, মিঠা পানির সরবরাহ প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেছে। পদ্মা অববাহিকায় গড় বৃষ্টিপাত কমেছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, আর তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মৎস্যসম্পদের ভয়াবহ ক্ষতি
পদ্মায় পানি কমে যাওয়ার কারণে এখানকার জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পদ্মার জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মৎস্য প্রজাতির সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, পদ্মায় ইলিশসহ অন্যান্য দেশীয় মাছের সংখ্যা কমে গেছে। একসময় হাজার হাজার জেলে পদ্মা নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, কিন্তু গত পাঁচ দশকে এদের ৭৫ শতাংশই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। বাঁধের ছায়ায় পদ্মার সংকট
গবেষণায় দেখা গেছে, ফারাক্কা চালুর আগে পদ্মায় বড় আকারের ইলিশ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন ছোট আকারের কিছু ইলিশ মিললেও তার পরিমাণ অনেক কম। পানির গভীরতা ও স্বচ্ছতা কমে যাওয়ায় ইলিশ পদ্মায় বেশি সময় অবস্থান করে না।
পানি প্রবাহ ও গঙ্গা চুক্তির সীমাবদ্ধতা
ভারত ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার পর থেকেই পদ্মার দুরবস্থা শুরু হয়েছে। বাঁধ চালুর আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহ ছিল ৯,০৩২ ঘনমিটার, যা এখন কমে ৫,১৪৬ ঘনমিটারে নেমে এসেছে। বছরের ছয় মাসই পদ্মায় পানি থাকে না।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৭ সালে প্রথম গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সামরিক সরকার এরশাদের আমলে এই চুক্তি দুইবার নবায়ন করা হয়, কিন্তু ১৯৮২ সালে চুক্তি নবায়নের সময় গ্যারান্টি ক্লজ বাদ দেওয়া হয়, যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা অনুযায়ী ৮০ শতাংশ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল।
১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তিতেও গ্যারান্টি ক্লজ রাখা হয়নি। বর্তমানে চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১০ দিন পরপর বাংলাদেশ ও ভারত ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে বাংলাদেশ আরও কম পানি পাচ্ছে।
ফারাক্কার ফলে আকস্মিক বন্যা ও ভূমি ক্ষয়
ফারাক্কায় সারা বছর পানি আটকে রাখা হলেও বর্ষায় হঠাৎ গেট খুলে দেওয়া হয়, যার ফলে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চর বাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদ রানা টিপু জানিয়েছেন, এই আকস্মিক বন্যায় ব্যাপক নদীভাঙন ও ফসলের ক্ষতি হয়। গত ৪০ বছরে নদীভাঙনে পদ্মার দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সমাধানের উপায় ও ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেছেন, ভারত আন্তর্জাতিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে গঙ্গার উৎস ও উজানে অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ করেছে, যার ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছাতে পারছে না। তিনি মনে করেন, ভারতের এই প্রকল্পগুলো অপসারণ করা ছাড়া গঙ্গা-পদ্মার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু এরপর কী হবে তা অনিশ্চিত। তিনি মনে করেন, পদ্মাকে রক্ষা করতে হলে খনন প্রকল্পের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।
শেষ কথা
পদ্মার অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। ফারাক্কা বাঁধের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ুতে মারাত্মক পরিবর্তন ঘটছে। কৃষি, মৎস্যসম্পদ, ভূগর্ভস্থ পানি ও মানুষের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। পদ্মাকে বাঁচাতে হলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এই সংকট মোকাবিলায় আমাদের মতামত জানা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি মনে করেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত? আপনার মতামত নিচে কমেন্টে জানান এবং আমাদের ওয়েবসাইট সাবস্ক্রাইব করুন নতুন আপডেটের জন্য।