তিস্তা নদীর সংকট: একটি পরিবেশগত সংকট
তিস্তা নদী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও জীবনযাত্রার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী না হলেও, উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। কিন্তু, গত দুই দশকে, এই নদীর পানি ক্রমাগত কমে যাওয়ায় তা পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। মূলত, ২০০৪ সাল থেকে ভারত তিস্তা নদী থেকে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করে, যা বাংলাদেশে এই নদীর পানি সংকটকে তীব্র করেছে। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন
তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ায়, উত্তরাঞ্চলের কৃষি জমি ধ্বংস হচ্ছে, মরুকরণের প্রভাব বাড়ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে ফসলের ক্ষতি এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত বন্যা এই অঞ্চলের জনগণের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর গভীরতা কমে গিয়ে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যও সংকটে পড়েছে, যার ফলে অনেক প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে।
প্রতিবাদ ও আন্দোলনের উদ্দেশ্য
‘তিস্তা বাঁচাও’ আন্দোলন শুরু হয়েছে তিস্তা নদী রক্ষায়, যা একদিকে নদী পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্য নিয়েছে, অন্যদিকে এই সংকটের কারণে পরিবেশগত ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের অধিকার আদায়ের দিকে এগিয়েছে। এই আন্দোলনটির মাধ্যমে জনগণ প্রধানত দুইটি বিষয় তুলে ধরছে:
- তিস্তার পানির ন্যায্য বণ্টন: ভারতীয় কর্তৃপক্ষের একতরফা পানির প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশি জনগণের কৃষি ও জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, নদীর পানি পুনরায় বাংলাদেশের জন্য বণ্টন করা হোক, যেন স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে পারে।
- তিস্তা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন: এই প্রকল্পের মাধ্যমে নদীটির শাসন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব, যাতে বন্যা ও খরা মোকাবিলা করা যায়। তিস্তা নদীর প্রকৃত দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা জন্য বাংলাদেশের সরকার ও ভারতীয় সরকারের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন
তিস্তার উপর স্থানীয় জনগণের প্রভাব ও ক্ষতি
বাংলাদেশের রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা—এই অঞ্চলের নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের জন্য তিস্তা একটি জীবনদায়ী উৎস। কৃষি নির্ভর এসব অঞ্চলে কৃষকরা তিস্তা নদীর পানি ব্যবহার করে তাদের ফসল ফলায়। কিন্তু তিস্তার পানি কমে যাওয়ায়, শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা ব্যাপক ফসলের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। নদীভাঙন ও বন্যা হচ্ছে আরো বেশি। যার ফলে জনসংখ্যার একটি বড় অংশের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তাছাড়া, তিস্তার পানি সংকটের কারণে এই অঞ্চলে পানি সরবরাহেরও সংকট তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় মানুষের জন্য দৈনন্দিন কাজকর্ম, যেমন খাওয়ার পানি ও কৃষি কাজে ব্যবহৃত পানি পাওয়া একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক চাপের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানে, বাংলাদেশের সরকারের কাছে ভারতের ওপর কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আলোচনা চললেও, সমাধান তেমনভাবে কার্যকর হয়নি। আন্দোলনকারীরা মনে করেন যে, সঠিক কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারতীয় সরকারকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে বাধ্য করা সম্ভব।
এই প্রসঙ্গে, বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, সরকার একে একে বাংলাদেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে এবং জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করছে। ১৬ বছর ধরে আশ্বাসের পরও তিস্তার প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়নি, যা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা
তিস্তা নদী রক্ষায় ‘তিস্তা মেগা প্রকল্প’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই প্রকল্পের আওতায় নদীটির সঠিক শাসন, পানি বণ্টন ব্যবস্থা এবং বাঁধের স্থায়ী সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। আরও, নদীটির সঠিক ব্যবস্থাপনা পরিবেশগতভাবে উপকারে আসবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলো মোকাবিলার দিকে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।
তিস্তা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে, নদীটির পানি রক্ষার পাশাপাশি, বন্যা নিয়ন্ত্রণে ও কৃষি জমির সুরক্ষা পাওয়া যাবে, যা শুধু নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির জন্যও এক বিরাট উন্নয়ন হবে।
শেষ কথা:
তিস্তা নদী রক্ষায় এই আন্দোলন কেবলমাত্র একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিবেশগত সংকটের একটি অংশ। বাংলাদেশ যদি তিস্তা নদীর সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং পানি বণ্টন চুক্তি কার্যকর করতে সক্ষম হয়, তবে এটি শুধুমাত্র তিস্তার বাঁচানো নয়, বরং দেশের অন্যান্য নদী এবং জলবায়ু ব্যবস্থাপনাকে স্থিতিশীল করতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।
CTA: তিস্তা বাঁচানোর আন্দোলনে অংশ নিন, এই সংকট সমাধানে আপনার মতামত দিন এবং আপনার অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করুন!