21.5 C
Bangladesh
সোমবার, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৫
spot_img

গাজীপুর সাফারি পার্ক: দুর্নীতির করাল গ্রাসে বন, প্রাণী ও পর্যটন

এক সময়ের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র গাজীপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক এখন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কবলে। পার্কটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে উঠেছে বন উজাড়, প্রাণী মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া, রাজস্ব ফাঁকি এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে পার্ক পরিচালনার গুরুতর অভিযোগ। এসব অনিয়ম শুধু পার্কের পরিবেশ নষ্ট করছে না, এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জলবায়ু এবং প্রাণী সংরক্ষণ কার্যক্রমেও। গাজীপুর সাফারি পার্ক

সংরক্ষিত বনাঞ্চলে নির্বিচারে গাছ কাটা: পরিবেশ ধ্বংসের আশঙ্কা

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই পার্কের অন্যতম মূল আকর্ষণ ছিল এর বিশাল বনাঞ্চল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অভিযোগ উঠেছে, রাতের আঁধারে গাছ কেটে তা পাচার করা হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, বিশেষ করে কচ্ছপ বেষ্টনীর দক্ষিণ পাশ এবং ঝুলন্ত সেতুর পশ্চিম দিক থেকে আকাশমণিসহ বিভিন্ন মূল্যবান গাছ রাতের আঁধারে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে।

একজন বন বিভাগের কর্মকর্তা জানান, “সংরক্ষিত এলাকায় গাছ কাটার কোনো অনুমতি নেই। কিন্তু কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে এই কাজ চলছে। এতে পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।”

প্রাণী মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে?

গাজীপুর সাফারি পার্কে প্রাণী মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর মারা যায় একটি সিংহ ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট। ২০২২ সালে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ এবং একটি সিংহ প্রাণ হারায়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবরে মারা গেছে একটি জিরাফ, যা পার্কের প্রাণী সংরক্ষণ কার্যক্রমের জন্য বড় ধাক্কা। গাজীপুর সাফারি পার্ক

একজন দায়িত্বশীল কর্মচারী বলেন, “প্রাণী মৃত্যুর পর তা ধামাচাপা দিতে অভ্যস্ত কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ প্রাণী প্রয়োজনীয় যত্ন ও খাদ্য পাচ্ছে না।”

রাজস্ব ফাঁকি ও অনিয়ম: প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা লোপাট!

দর্শনার্থীদের প্রবেশ টিকিট থেকে শুরু করে পার্কের বিভিন্ন ইজারা কার্যক্রমেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দলবদ্ধ দর্শনার্থীদের প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ টিকিট না কেটেই প্রবেশ করানো হয়, এবং এই অর্থ চলে যায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পকেটে। এতে সরকারের প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।

একজন কর্মী জানান, “প্রতি বছর কোর সাফারি ইজারার মাধ্যমে ৫ কোটি টাকার রাজস্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু ইজারা না দিয়ে এই অর্থ ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

পাখির সঙ্গে সেলফির নামে টাকা আদায়

পার্কের অন্যতম জনপ্রিয় অংশ ‘ম্যাকাও পাখিশালা’। এখানে দর্শনার্থীদের কাঁধে পাখি বসিয়ে ছবি তোলার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে বিনিময়ে জনপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এই অর্থ সরকারি রেকর্ডে দেখানো হচ্ছে না। অথচ, বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, দর্শনার্থীদের কোনো প্রাণীর সংস্পর্শে যাওয়ার অনুমতি নেই।

বিকাল ৪টার পর বেআইনি প্রবেশের সুযোগ

পার্কের নিয়ম অনুযায়ী বিকাল ৪টার পর দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে কিছু অসাধু কর্মচারী টাকা নিয়ে নিয়ম ভেঙে লোকজনকে প্রবেশ করাচ্ছেন। টিকিট ছাড়াই ১৫০ টাকা করে নিয়ে ভেতরে ঢোকার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

সরেজমিন তদন্ত: বাস্তবে কী ঘটছে?

স্থানীয় সূত্র এবং সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে:

  1. পার্কের মূল গেটের বাইরে অবৈধ দোকান বসিয়ে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হচ্ছে।
  2. বিকাল ৪টার পরও দর্শনার্থীদের বেআইনি প্রবেশ করানো হচ্ছে।
  3. ‘ম্যাকাও পাখিশালা’-তে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে অননুমোদিতভাবে টাকা নেওয়া হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ কী বলছে?

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “বেশি দর্শনার্থীর ভিড় হলে কিছু লোক টিকিট ছাড়াই ঢুকে যেতে পারে, তবে আমরা চেষ্টা করছি এটি বন্ধ করতে।” গাছ কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, “এসব গাছ দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। তবে বিক্রির পর গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে।”

অন্যদিকে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, “গাজীপুর সাফারি পার্কে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আসেনি। তবে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সচেতনতা ও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান

গাজীপুর সাফারি পার্ক শুধু বিনোদনের জায়গা নয়, এটি দেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র। কিন্তু যদি অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা না হয়, তাহলে এটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাবে না, বরং পরিবেশ ও প্রাণীজগতের ওপরও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আপনার মতামত দিন! আপনার অভিজ্ঞতা বা মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রতিবেদনটি শেয়ার করুন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ