দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং সরকারী সংস্কারের তোড়জোড় চললেও সুনামগঞ্জের যাদুকাটার নদী এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। এখানে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের মহোৎসবে তেমন কোনো ভাটা পড়েনি। নদীর উপকূলে ক্ষতির শিকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার গ্রামবাসী এবং এই অশান্তির পেছনে বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একদিকে প্রশাসনের শিথিলতা, অন্যদিকে স্থানীয় নেতা এবং ইজারাদারদের মুনাফা প্রাপ্তির তীব্র আগ্রহ, সব মিলিয়ে যাদুকাটা নদী আজ বিপদের সম্মুখীন। অবৈধ বালু ও পাথর উত্তোলন
১. যাদুকাটা নদী: পরিবেশের উপর হুমকি
যাদুকাটা নদী সুনামগঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা স্থানীয়দের জীবনযাত্রার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সেখানে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন কার্যক্রমের কারণে নদীর তলদেশে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। নদীটি এখন প্রায় দখল হয়ে গেছে, এবং একসময় পরিচিত এলাকার নদী পাড় এখন হাওরের মতো বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এভাবে নদী কাটলে তাঁদের বাড়িঘর, ফসলি জমি এবং জীবিকা সবই ঝুঁকিতে পড়ে। অবৈধ বালু ও পাথর উত্তোলন
২. প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় নদীটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর বাসিন্দারা বার বার প্রতিবাদ জানালেও তাদের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। প্রশাসন বরং স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে এই অবৈধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে। বিশেষ করে, বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যা স্থানীয় “বালুখেকোরা”দের আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে সহায়তা করছে।
৩. ‘সেইভ মেশিন’ এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব
এই নদীতে ‘সেইভ মেশিন’ নামে একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, যা অতিরিক্ত বালু এবং পাথর উত্তোলন করতে সাহায্য করে। এই মেশিনের ব্যবহার পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। এটি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এতে করে নদীর পানির স্তর কমে যাচ্ছে এবং নদীভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, একসময় নদীর পাড় ছিল যা বর্তমানে প্রায় উধাও হয়ে গেছে।
৪. রাজনৈতিক দলের শৃঙ্খলাবিহীনতা
প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অবৈধ বালু উত্তোলনের জন্য কিছুটা পারস্পরিক সহমর্মিতা রয়েছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় দলই একসময় এই অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল, তবে বর্তমানে বিএনপি দলীয় নেতাদের নাম উঠে আসছে। বিশেষ করে, তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জুনাব আলীকে কেন্দ্র করে অনেক অভিযোগ উঠেছে। যদিও তিনি নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন, তবে গ্রামের লোকজনের মতে, তিনি এই কার্যক্রমে জড়িত।
৫. রাজস্ব হারানো এবং সরকারের দায়িত্ব
সরকারি রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন। জেলা প্রশাসন অবশ্যই বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা প্রদান করছে, তবে সেই ইজারার মূল্য অনেক কম হওয়ায় রাজস্ব আয় কিছুটা কমছে। আরো ভয়াবহ বিষয় হলো, সরকার এই ইজারা কার্যক্রমের মাধ্যমে সুনামগঞ্জের নদীভূমি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার পরিবেশ রক্ষায় কিছুই করছেন না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করছে, যার ভাগ কিছুটা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পৌঁছে যায়।
৬. স্থানীয় জনগণের চরম ক্ষতি
স্থানীয় জনগণ প্রতিদিন এই অবৈধ কার্যক্রমের শিকার হচ্ছে। নদী তীরের অনেক বাড়িঘর এখন নদীর পানির নিচে চলে যাচ্ছে, এবং সেইসব জায়গা আজ বিলীন হতে বসেছে। গ্রামবাসীরা সরকারের প্রতি অভিযোগ করছেন যে, তারা এই ক্ষতি ঠেকানোর জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অনেকেই জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন, কারণ তারা জানেন যে, যদি তারা তা না করেন, তাদের জমি নদীতে চলে যাবে।
৭. সমাধান কী?
যাদুকাটা নদীর অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। এখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। স্থানীয় প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে এবং অবৈধ বালু উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। একদিকে রাজস্ব বৃদ্ধি করা, অন্যদিকে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, এটাই সরকারের উচিত কাজ।
শেষ কথা: যাদুকাটা নদী ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার ক্ষতির মোকাবিলা করতে হলে রাজনৈতিক ইস্যুগুলিকে পাশ কাটিয়ে শুধু মানুষের জীবন ও পরিবেশের সুরক্ষা দিকে নজর দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অতি দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপই কেবল এই বিপর্যয় রোধ করতে পারে।