পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে মৎস্য অভয়াশ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো কেবল মাছের বংশবৃদ্ধির জায়গা নয়, বরং জলজ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও বড় অবদান রাখে। তবে দুঃখজনকভাবে, ময়মনসিংহের নান্দাইলের টঙ্গীর বিলের একটি সরকারি মৎস্য অভয়াশ্রম দখল করে পুকুর খননের অভিযোগ উঠেছে এক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে। আ.লীগ নেতার পুকুর খনন
এ ধরনের কার্যকলাপ শুধুমাত্র আইনবিরোধী নয়, এটি পরিবেশের ওপরও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে আমরা ঘটনার বিস্তারিত, এর সম্ভাব্য প্রভাব এবং এ ধরনের ঘটনার প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করব।
অভয়াশ্রম দখলের ঘটনা ও অভিযোগ
সরকারি নথি অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ লাখ টাকা ব্যয়ে টঙ্গীর বিলে মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়। প্রতিবছর এখানে মাছের অবমুক্তকরণ ও সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে অভয়াশ্রমের সংস্কার করা হয়, যেখানে স্থায়ী সাইনবোর্ড এবং লাল নিশান দিয়ে এলাকাটি চিহ্নিত করা ছিল। আ.লীগ নেতার পুকুর খনন
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একেএম মোফাজ্জল হোসেন কাইয়ুম ওই অভয়াশ্রম দখল করে সেখানে পুকুর খনন করছেন। এক সপ্তাহ ধরে সেখানে ভেকু (খননযন্ত্র) দিয়ে গভীরভাবে মাটি কেটে নতুন পুকুর তৈরি করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, এই পুকুর কাটার ফলে অভয়াশ্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সরকারি সাইনবোর্ড গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে সত্যতা পেয়েছেন এবং বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেছেন। প্রশাসন বিষয়টি তদন্ত করছে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব
১. মাছের প্রজনন ব্যাহত হবে
মৎস্য অভয়াশ্রম হলো প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশের অংশ, যেখানে মাছ নির্ভয়ে ডিম পাড়তে ও বড় হতে পারে। অভয়াশ্রম দখল ও ধ্বংসের ফলে এই মাছের জীবনচক্র ব্যাহত হবে, যার প্রভাব পড়বে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রায়।
২. জলজ বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি
একটি অভয়াশ্রম শুধু মাছের জন্যই নয়, এটি বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্যও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। অভয়াশ্রম ধ্বংস করা মানে এই বাস্তুসংস্থানের ওপর সরাসরি আঘাত হানা, যা দীর্ঘমেয়াদে ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
৩. মাটির গুণাগুণ পরিবর্তন ও জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি
বেপরোয়া খননের ফলে মাটির গঠন পরিবর্তিত হয়, যা স্থানীয় কৃষিকাজ ও পানির প্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অভয়াশ্রম দখলের ফলে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
প্রাকৃতিক জলাশয় ধ্বংস হলে তার প্রভাব শুধু স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুর ওপরও প্রভাব ফেলে। জলাশয় কমে গেলে স্থানীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বৃষ্টির প্রবণতাও কমতে পারে।
কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও করণীয়
সরকারি অভয়াশ্রম রক্ষায় প্রশাসনের আরও কঠোর মনোভাব গ্রহণ করা প্রয়োজন।
✅ আইনগত ব্যবস্থা: দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
✅ স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা: অভয়াশ্রম রক্ষায় স্থানীয় বাসিন্দাদের আরও সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে।
✅ নজরদারি ও টহল বৃদ্ধি: প্রশাসন ও পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোকে অভয়াশ্রমের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
✅ জনসচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবেশ রক্ষায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা যায়।
শেষ কথা
মৎস্য অভয়াশ্রম ধ্বংসকরণ কেবল একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিকভাবে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে। এমন বেআইনি কার্যকলাপ রোধ করতে হলে প্রশাসন, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং স্থানীয় জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আপনার মতামত কী? মৎস্য অভয়াশ্রম রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? আপনার মতামত কমেন্টে জানান এবং পরিবেশ রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দিতে পোস্টটি শেয়ার করুন।