26.5 C
Bangladesh
বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
spot_img

বন্য প্রাণী পাচারের গোপন রুট: পাহাড় থেকে কীভাবে বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে?

বাংলাদেশে বন্য প্রাণী পাচারের ভয়াবহ চিত্র

বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলো একসময় কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত ছিল, কিন্তু এখন তা একটি ভয়ংকর অপরাধচক্রের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বন্য প্রাণী অবৈধভাবে সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কুষ্টিয়ায় ১১টি মুখপোড়া হনুমান উদ্ধার হওয়ার ঘটনা, কিংবা ঢাকায় আটটি হনুমান উদ্ধার হওয়ার বিষয়টি এই সমস্যার ভয়াবহতাকে সামনে এনেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বন্য প্রাণী পাচার একটি বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও জলবায়ুর জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। বন্য প্রাণী পাচারের গোপন রুট

পাহাড় থেকে পাচারের প্রধান রুট

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা—বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি—হলো বন্য প্রাণী পাচারের প্রধান উৎস। এসব প্রাণী সাধারণত বান্দরবান থেকে লামা হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছায়। এছাড়া লামা থেকে কোয়ান্টাম এলাকা হয়ে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় একটি রুট রয়েছে, যেখানে তেমন কোনো চেকপোস্ট নেই। স্থানীয়দের মতে, এই দুটি সড়কই বন্য প্রাণী পাচারের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে কিছু চেকপোস্ট থাকলেও বিকল্প গ্রামীণ পথগুলোতে তেমন নজরদারি নেই। বনের ভেতর দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরেও প্রাণী পাচার করা হয়। প্রশাসন বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব স্পষ্ট।

বন্য প্রাণী পাচার বাড়ছে কেন?

বন্য প্রাণী পাচারের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক লাভজনকতা। আন্তর্জাতিক বাজারে বন্য প্রাণীর চাহিদা অত্যন্ত বেশি, বিশেষত বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে। পাচারকারীরা সহজেই এই অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ উপার্জন করতে পারে। বন্য প্রাণী পাচারের গোপন রুট

আইনের দুর্বল প্রয়োগও এই অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন থাকলেও, অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অভাব রয়েছে। বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকায় পাচারকারীরা সহজেই ধরা এড়িয়ে যেতে পারে।

বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের জনবল সংকটও এই অপরাধ রোধে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় দেশের সব অঞ্চলে নজরদারি করা সম্ভব হয় না। স্থানীয়দের সহযোগিতা পাচারকারীদের কাজ আরও সহজ করে দেয়। অনেক সময় দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এই চক্র সক্রিয় থাকে, যা পাচার বন্ধের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে।

নৌপথেও পাচার চলছে, কিন্তু নজরদারি কম

শুধু সড়কপথ নয়, নৌপথ ব্যবহার করেও বন্য প্রাণী পাচার করা হয়। ২০১২ সালে প্রণীত বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী প্রায় ১,৩০০ প্রজাতির প্রাণীকে রক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীগুলো পাচার হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দর ও টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে গত এক দশকে পাঁচটি হাঙরের চালান রপ্তানির তথ্য পাওয়া গেছে, যার মোট ওজন ২,৩৬৭ কেজি। এই চালান থেকে পাচারকারীরা ৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা সমপরিমাণ ডলার আয় করেছে। স্থানীয় জেলেরা প্রায়ই হাঙর ও রে মাছ ধরেন এবং বাজারে বিক্রি করেন, যা সরাসরি জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।

বন্য প্রাণী পাচারের পরিবেশগত প্রভাব

বন্য প্রাণী পাচার বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে। প্রতিটি প্রাণী তার নিজস্ব পরিবেশে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে, যা খাদ্যশৃঙ্খল ও প্রকৃতির সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। পাচার ও অবৈধ শিকারের ফলে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের গতিও বন্য প্রাণী পাচারের মাধ্যমে বাড়তে পারে। বন্য প্রাণীর সংখ্যা কমে গেলে বনাঞ্চলের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। উদাহরণস্বরূপ, হাতির মতো প্রাণী বনের গাছপালা ও উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এদের সংখ্যা কমে গেলে বনাঞ্চলের কাঠামো পরিবর্তিত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে।

বন্য প্রাণী পাচারের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ে। বন্য প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। করোনাভাইরাস মহামারির সময় আমরা দেখেছি যে, বন্য প্রাণী থেকে সংক্রমিত হওয়া ভাইরাস কীভাবে বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।

বন্য প্রাণী পাচার রোধে করণীয়

বন্য প্রাণী পাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি বন বিভাগ, পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাবের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

প্রযুক্তির ব্যবহার এই অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পাচার রুটে ড্রোন ও সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হলে পাচারকারীদের শনাক্ত করা সহজ হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও অপরিহার্য। ইন্টারপোল ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

শেষ কথা

বাংলাদেশে বন্য প্রাণী পাচার রোধ করা এখন সময়ের দাবি। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা বন বিভাগের দায়িত্ব নয়, বরং সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সচেতনতা ও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসের এই প্রতিপাদ্য—“বন্য প্রাণী সংরক্ষণে অর্থায়ন, মানুষ ও ধরিত্রীর উন্নয়ন”—বাস্তবায়নের জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এই বিষয়ে আপনার মতামত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার এলাকায় বন্য প্রাণী পাচার নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা থাকলে বা আপনি কীভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করা যায় বলে মনে করেন, তা আমাদের জানান। সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে আপনার অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ