বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমায়। কিন্তু সম্প্রতি সৈকতের এক করুণ বাস্তবতা পরিবেশবিদ ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে—একটি, দুটি নয়, শত শত মৃত মা কাছিম ভেসে আসছে সৈকতে। মূলত, গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসা অলিভ রিডলে প্রজাতির কাছিমগুলোর বেশির ভাগই নিষিদ্ধ জালে আটকে পড়ে মারা যাচ্ছে। গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের অভাবে এই মৃত্যু প্রবণতার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান কঠিন হয়ে উঠেছে। এই পোস্টে আমরা কক্সবাজার উপকূলে মা কাছিমের মৃত্যুর কারণ, এর পরিবেশগত প্রভাব ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্লেষণ করব। মৃত মা কাছিম ভেসে আসছে
সৈকতে ভেসে আসা মৃত কাছিম: ভয়াবহ পরিস্থিতি
কক্সবাজার উপকূলে সাম্প্রতিক সময়ে মৃত কাছিমের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থাগুলোর তথ্য অনুসারে, গত আড়াই মাসে কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার সৈকতে ২৪০টির বেশি মা কাছিম ভেসে এসেছে, যার ৯০ শতাংশের শরীরে আঘাতের চিহ্ন এবং পেটে ডিম ছিল।
একটি বেসরকারি সংস্থার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসে ১৩৫টি ও ফেব্রুয়ারিতে ৮৭টি কাছিম মারা গেছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই মরা কাছিম ভেসে আসছে। সাধারণত, প্রতি কিলোমিটার সৈকতে গড়ে তিনটি করে মরা কাছিম দেখা যাচ্ছে।
সরেজমিন চিত্র
কক্সবাজারের নাজিরারটেক সৈকতে গিয়ে দেখা গেছে, একটি মৃত কাছিমের শরীরে গভীর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে, এবং তার একটি পা নেই। স্থানীয় জেলেরা জানান, সৈকতে ভেসে আসা অধিকাংশ মৃত কাছিম কুকুর ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হয় বা বালুর নিচে পুঁতে ফেলা হয়।
কাছিম মৃত্যুর কারণ কী?
১. নিষিদ্ধ জালে আটকে মৃত্যু
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৬৫,০০০ ট্রলার মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত। এদের মধ্যে অনেকেই নিষিদ্ধ ফাঁদজাল (বিহিন্দি, কারেন্ট ও ফাঁসজাল) ব্যবহার করে, যা কাছিমের জন্য ভয়ংকর ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়। ডিম পাড়তে আসার সময় কাছিমগুলো এই জালে আটকে যায় এবং মুক্ত হওয়ার সুযোগ না পেয়ে ডুবে মারা যায়।
২. ট্রলারের ধাক্কা ও যান্ত্রিক আঘাত
গভীর সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ ধরার ট্রলারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ট্রলারগুলোর প্রপেলারের ধাক্কায় অনেক কাছিম মারাত্মকভাবে আহত হয়, যা তাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। মৃত মা কাছিম ভেসে আসছে
৩. দূষণ ও প্লাস্টিক বর্জ্য
সাগরে ফেলা প্লাস্টিক, পরিত্যক্ত জাল ও রাসায়নিক বর্জ্য কাছিমসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক কাছিমের শরীরে ছেঁড়া জাল ও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা তাদের স্বাভাবিক চলাচল ও খাদ্যগ্রহণ ব্যাহত করে।
৪. আবাসস্থল সংকট
কাছিম সাধারণত নির্জন ও নিরাপদ সৈকতে ডিম পাড়ে। কিন্তু পর্যটন শিল্পের অতি সম্প্রসারণ ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে তাদের প্রজননের উপযুক্ত স্থান কমে যাচ্ছে। সৈকতে কৃত্রিম আলোকসজ্জা, বিচ ডাইভিং, খেলাধুলা ও মানব চলাচলের কারণে কাছিমরা স্বাভাবিক পরিবেশ হারাচ্ছে।
কাছিমের বিলুপ্তির আশঙ্কা
একসময় কক্সবাজারের সৈকতে তিনটি প্রজাতির কাছিম—হক্সবিল, গ্রিন টার্টল ও অলিভ রিডলে নিয়মিত ডিম পাড়তে আসত। কিন্তু গত ১০-১২ বছরে হক্সবিল ও গ্রিন টার্টল পুরোপুরি হারিয়ে গেছে, এবং এখন অলিভ রিডলের সংখ্যাও দ্রুত কমছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রজনন মৌসুমে বিপুলসংখ্যক মা কাছিম মারা গেলে ভবিষ্যতে এই প্রজাতির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
গবেষণার অভাব: সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?
অলিভ রিডলে কাছিমের প্রজনন, বিচরণ ও মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তিনটি কাছিমের শরীরে স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং যন্ত্র বসানো হয়েছিল, কিন্তু তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
২০২৪ সালে দুটি মা কাছিমকে ট্র্যাক করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাদেরও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। গবেষণার অভাবে এই প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কার্যকর নীতিমালা তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সম্ভাব্য সমাধান ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
কাছিম রক্ষার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রয়োগ ও গবেষণা উদ্যোগ।
১. নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বন্ধ করা
সরকারি উদ্যোগে সমুদ্র এলাকায় নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। জেলেদের জন্য বিকল্প টেকসই মাছ ধরার পদ্ধতি চালু করতে হবে, যাতে তারা জীবিকা হারানোর আশঙ্কা ছাড়াই পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে মাছ ধরতে পারে।
২. সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা
জেলেদের সচেতন করতে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করা দরকার, যাতে তারা বুঝতে পারেন কাছিম সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
৩. গবেষণা ও নজরদারি বৃদ্ধি
কাছিমের মৃত্যু ও প্রজনন সংক্রান্ত গবেষণা বাড়ানো দরকার, যাতে কার্যকর সংরক্ষণ নীতি প্রণয়ন করা যায়। ট্র্যাকিং প্রযুক্তির ব্যবহার করে কাছিমের চলাচলের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা
কক্সবাজার উপকূলে কাছিম সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম হ্যাচারি বা প্রজনন কেন্দ্র বাড়াতে হবে। এতে ডিমগুলো নিরাপদে সংরক্ষণ করে কাছিমের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হবে।
শেষ কথা: আমাদের করণীয় কী?
কক্সবাজার উপকূলে মা কাছিমের মৃত্যু শুধু পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, বরং সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের জন্য বড় হুমকি। নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার, ট্রলারের সংখ্যা বৃদ্ধি, দূষণ এবং পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণের কারণে কাছিমের নিরাপদ প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে অলিভ রিডলে কাছিমও বিলুপ্তির পথে হাঁটবে।
আপনার ভূমিকা কী হতে পারে?
- কাছিম রক্ষার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করুন এবং সামাজিক মাধ্যমে তথ্য শেয়ার করুন।
- পর্যটনকেন্দ্র ও সমুদ্র সৈকতে প্লাস্টিক ও বর্জ্য পরিত্যাগ করা থেকে বিরত থাকুন।
- নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন ও সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করুন।
- পরিবেশবান্ধব পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিন।
পরিবেশ রক্ষা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে আগামী দিনে হয়তো কক্সবাজারের সৈকতে কাছিম দেখা যাবে শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায়!