26.8 C
Bangladesh
বুধবার, জুন ২৫, ২০২৫
spot_img

রাজধানীতে শব্দদূষণের তাণ্ডব: ঢাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা ভয়াবহ?

শব্দদূষণের চরম পর্যায়: রাজধানীর বাস্তবতা

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে এক মুহূর্তের জন্যও যেন নীরবতা নেই। যানবাহনের লাগাতার হর্ন, নির্মাণ কাজের কোলাহল, লাউডস্পিকারের উচ্চ শব্দ—সবকিছু মিলে রাজধানীর শব্দদূষণ এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শব্দ প্রতিনিয়ত নাগরিকদের শ্রবণস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে, যা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

শব্দদূষণের ভয়াবহতা: গবেষণায় কী বলছে?

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে শব্দদূষণপ্রবণ শহরগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে। ঢাকার কিছু এলাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা স্বাভাবিক মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। অথচ আবাসিক এলাকায় সর্বোচ্চ অনুমোদিত শব্দ মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এবং বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবেল।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় উচ্চ মাত্রার শব্দে থাকার ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যেতে পারে, পাশাপাশি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা এর সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে।

শব্দদূষণের কারণ: কোথা থেকে আসছে এত শব্দ?

রাজধানীতে শব্দদূষণের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে প্রধান ভূমিকা রাখছে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত হর্ন বাজানো। ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা গাড়িগুলো অযথাই হর্ন বাজিয়ে শব্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা শুধু বিরক্তিকর নয়, দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকরও। আবাসিক এলাকাগুলোতে নির্মাণ কাজের অতিরিক্ত শব্দও নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।

মাইকের উচ্চ শব্দও একটি বড় সমস্যা। সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ের আয়োজন, রাজনৈতিক সমাবেশ ও ধর্মীয় কার্যক্রমে নিয়ম ভেঙে উচ্চশব্দে মাইক ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। এ ছাড়া শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবও এটি নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আইন থাকলেও তার কার্যকারিতা তেমন দেখা যায় না, ফলে রাজধানীর শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

শব্দদূষণের ভয়াবহ প্রভাব

শব্দদূষণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যেতে পারে, যা স্থায়ী বধিরতার দিকে ঠেলে দেয়। অতিরিক্ত শব্দ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।

শিশুরাও শব্দদূষণের বড় শিকার। তারা শব্দের প্রতি বেশি সংবেদনশীল, তাই অতিরিক্ত শব্দ তাদের শেখার ক্ষমতা, মনোযোগ ও মস্তিষ্কের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ ও যাদের হার্টের সমস্যা আছে, তাদের জন্য শব্দদূষণ আরও ক্ষতিকর।

আইন ও বাস্তবতা: নীরব এলাকা ঘোষণা কতটা কার্যকর?

সরকার শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে কিছু এলাকা ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রাজধানীর শ্যামলী, আগারগাঁওসহ কিছু জায়গায় স্বেচ্ছাসেবকরা জনগণকে সচেতন করতে কাজ করছে, তারা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে হর্ন বাজানো বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব এলাকায়ও নিয়মিত হর্ন বাজানো হচ্ছে, নির্মাণকাজ চলছে, মাইকের শব্দে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ এখনো প্রতিদিন শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে কোন এলাকায় দিনের কোন সময়ে শব্দের মাত্রা কত হওয়া উচিত। আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্যান্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করা যাবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটারের মধ্যে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে রাতে ৪০ এবং দিনে ৫০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে এসব আইন মানা হচ্ছে না বললেই চলে।

সমাধানের পথ কোনটি?

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। প্রথমত, অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজানো বন্ধ করতে হবে এবং যারা নিয়ম ভাঙবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যানবাহনের চালকদের সচেতন করতে ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে নিয়মিত প্রচারণা চালানো উচিত।

নির্মাণকাজের শব্দ নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যাতে রাতে বা ভোরবেলায় নির্মাণের শব্দ মানুষকে বিরক্ত না করে। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।

শব্দদূষণ রোধে জনসচেতনতা বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না, নাগরিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।

শেষ কথা

শব্দদূষণ শুধু একটি সাধারণ সমস্যা নয়, এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংকট। রাজধানীতে বসবাস করা মানুষের জীবন যেভাবে শব্দদূষণের কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে, তা আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সরকার, প্রশাসন এবং সাধারণ নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ঢাকার মানুষের জন্য ভবিষ্যৎ আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। নগর জীবনে একটু শান্তি পেতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং আইন প্রয়োগে কঠোরতা আনতে হবে।

আপনার এলাকায় শব্দদূষণের পরিস্থিতি কেমন? আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ