বাংলাদেশে গ্যাস সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প ও গৃহস্থালির ব্যবহার মেটাতে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হচ্ছে। অথচ সেই গ্যাসের বড় একটি অংশ অপচয় হয়ে যাচ্ছে, যার দায় দেওয়া হচ্ছে তথাকথিত কারিগরি ক্ষতির ওপর। পাইপলাইনের লিকেজ, অবৈধ সংযোগ, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা—সব মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হচ্ছে, যার চাপ শেষ পর্যন্ত এসে পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। কারিগরি ত্রুটিতে গ্যাস অপচয়
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই ১৩৭ কোটি ঘনমিটার গ্যাস অপচয় হয়েছে। প্রতিটি ঘনমিটারের পেছনে সরকারের খরচ ৭৯ টাকা ৩৪ পয়সা। হিসাব করলে দাঁড়ায়, মাত্র ছয় মাসেই ১০ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়েছে! এভাবে চলতে থাকলে পুরো অর্থবছর শেষে ক্ষতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়।
কেন এই গ্যাস অপচয়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস অপচয়ের মূল কারণ তিনটি। প্রথমত, দেশের বেশিরভাগ গ্যাস পাইপলাইন অনেক পুরোনো। ফলে লিকেজ হয়ে প্রতিনিয়ত গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ সেই ক্ষতি ঠেকানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, পাইপলাইনে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ২০ থেকে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ গ্যাস অপচয় হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দেশে এই হার অনেক বেশি, যা আসলে অব্যবস্থাপনারই প্রমাণ। কারিগরি ত্রুটিতে গ্যাস অপচয়
দ্বিতীয় কারণ অবৈধ সংযোগ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর পাইপলাইনের সঙ্গে অবৈধ সংযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস চুরি চলছে। বিশেষ করে তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির ক্ষেত্রে এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি। যদিও মাঝে মাঝে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে অভিযান চালানো হয়, তবুও মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
তৃতীয়ত, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতি। গ্যাস চুরি বা পাইপলাইনের ক্ষতির জন্য গ্রাহকদের দোষারোপ করা হলেও, মূলত এই কোম্পানিগুলোর অব্যবস্থাপনাই গ্যাস অপচয়ের বড় কারণ। অনেক সময় কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেও পাইপলাইনের মেরামত বিলম্বিত হয়, ফলে দীর্ঘদিন ধরে লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে যেতে থাকে।
গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে
গ্যাস কোম্পানিগুলো নিজেরাই বলছে, গ্যাস সরবরাহের সময় প্রচুর পরিমাণে অপচয় হচ্ছে, কিন্তু সেই ক্ষতি পোষানোর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সাধারণ গ্রাহকদের ওপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গৃহস্থালি গ্রাহকরা সাধারণত দুই চুলার সংযোগ নিয়ে মাসে সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন। অথচ তাদের বিল ধরা হচ্ছে ৭৮ ঘনমিটার হিসাবে, যার ফলে প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে ২৮ ঘনমিটারের বাড়তি দাম আদায় করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ গৃহস্থালি গ্রাহক রয়েছেন। প্রতিমাসে এই বাড়তি বিলের অঙ্ক কত হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কোম্পানিগুলো নিজেদের অব্যবস্থাপনা ঢাকতে সাধারণ মানুষের পকেট থেকেই টাকা নিচ্ছে। আর শিল্প খাতেও সমস্যা কম নয়। অনেক শিল্প মালিক অভিযোগ করছেন, গ্যাসের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণের জন্য ইলেকট্রনিক ভলিউম ক্যারেক্টার (ইভিসি) মিটার ব্যবহার করা হলে গ্যাসের সঠিক হিসাব পাওয়া যেত। কিন্তু গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ইভিসি মিটার বসাচ্ছে না, কারণ তাতে তাদের কারিগরি অপচয়ের গল্প আর বলা যাবে না।
পরিবেশের জন্য ভয়ংকর গ্যাস অপচয়
গ্যাস অপচয় শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, পরিবেশের জন্যও ভয়ংকর এক হুমকি। প্রাকৃতিক গ্যাস প্রধানত মিথেন গ্যাস দ্বারা গঠিত, যা একপ্রকার গ্রিনহাউস গ্যাস এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও ৮০ গুণ বেশি শক্তিশালী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। যখন পাইপলাইনের লিকেজ বা অবৈধ সংযোগের কারণে গ্যাস অপচয় হয়, তখন শুধু অর্থ নয়, বায়ুমণ্ডলেও প্রচুর পরিমাণ মিথেন নির্গত হয়। এটি তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটছে। কিন্তু যখন কারিগরি অব্যবস্থাপনার কারণে প্রচুর গ্যাস অপচয় হয়, তখন সেটি আরও ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী মিথেন নিঃসরণ কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, অথচ বাংলাদেশে অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস ব্যবস্থাপনার কারণে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে।
এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রেও পরিবেশগত ক্ষতি রয়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস প্রস্তুত ও পরিবহনের জন্য প্রচুর শক্তি ব্যয় হয় এবং এটি পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে। তাই যদি আমরা এই মূল্যবান সম্পদ অপচয় করি, তাহলে এটি শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, বরং জলবায়ুর জন্যও বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গ্যাস অপচয় কমাতে কী করা দরকার?
গ্যাস অপচয় রোধে প্রথমেই পুরোনো পাইপলাইন সংস্কার ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে অনেক গ্যাস পাইপলাইন বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছে, যেগুলোতে একাধিক জায়গায় লিকেজ তৈরি হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে লিকেজ শনাক্ত করে তা দ্রুত মেরামত করা গেলে অপচয়ের বড় একটি অংশ কমানো সম্ভব।
অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে নিয়মিত ও কঠোর অভিযান পরিচালনা করা জরুরি। মাঝে মাঝে লোক দেখানো কিছু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। যেসব এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ বেশি, সেগুলোতে বিশেষ নজরদারি বাড়াতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গ্রাহকদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। গ্যাসের প্রকৃত ব্যবহার অনুযায়ী বিল নির্ধারণ করতে হবে। গৃহস্থালি গ্রাহকদের ওপর বাড়তি চাপ দেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং গ্যাস চুরি বা অপচয়ের দায় তাদের ঘাড়ে চাপানো যাবে না।
অবশেষে, গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলোর প্রশাসনিক দুর্নীতি ও ব্যর্থতা বন্ধ করতে হবে। যারা গ্যাস অপচয়ের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্যাস সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এ সমস্যা কোনোদিনই সমাধান হবে না।
শেষ কথা
বাংলাদেশে গ্যাস সংকটের মূল কারণ একদিকে উৎপাদনের ঘাটতি, অন্যদিকে ব্যাপক অপচয়। যদি অবৈধ সংযোগ, পাইপলাইনের লিকেজ ও দুর্নীতির কারণে গ্যাস অপচয় বন্ধ করা যায়, তাহলে হয়তো বিদেশ থেকে এত চড়া দামে গ্যাস আমদানি করতে হবে না। সরকারের উচিত এই সমস্যার সমাধানে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে সাধারণ মানুষকে বাড়তি বিল গুনতে না হয়। গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে না পারলে, এ সংকট আগামী দিনে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
আপনার এলাকাতেও কি গ্যাস সংযোগ নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে? অপচয় বন্ধে আপনার কী পরামর্শ? কমেন্টে জানান আপনার মতামত।