প্রতি বছর এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছে, আর এবারের পরিস্থিতিও এর ব্যতিক্রম নয়। আবহাওয়াবিদদের মতে, চলতি বছর মাসব্যাপী টানা তাপপ্রবাহের আশঙ্কা তুলনামূলক কম হলেও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকবে। মার্চের মাঝামাঝিতেই দেশের কিছু এলাকায় তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে, যা পুরো এপ্রিলে আরও তীব্র হতে পারে। এপ্রিলে আগুন গরম আসছে
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্যারিস চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা অতিক্রম করেছে। গত বছর এই মাত্রা ছিল ১.৪৫ ডিগ্রি। ধারাবাহিকভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় এবারও নতুন রেকর্ড গড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশেও এর প্রভাব স্পষ্ট। দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত শীত মৌসুমেই তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি ছিল। এর ফলে শীতের প্রকোপ কম থাকলেও গরমের তীব্রতা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে তাপপ্রবাহের প্রবণতা দীর্ঘ হচ্ছে এবং তা জনজীবনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
সরকারি প্রস্তুতি কতটা কার্যকর?
তাপপ্রবাহের ভয়াবহতা মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে সিটি করপোরেশন পর্যায়ে কিছু পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এপ্রিলে আগুন গরম আসছে
একজন প্রশাসক জানিয়েছেন, বর্ষার জন্য বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা থাকলেও এপ্রিলের ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। তবে ঢাকায় ১০০ একরের ওপর জলাধার সংরক্ষণ, ১৯টি খাল মুক্তকরণ এবং দখল ঠেকাতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। হিটপ্রবণ এলাকায় কৃত্রিম বৃষ্টি (স্প্রিংলার) স্থাপনের পরিকল্পনাও করা হয়েছে, যা কিছুটা হলেও নগরীর তাপমাত্রা কমাতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি রাস্তার মোড়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হবে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালানো হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে কিছুটা সহায়ক হলেও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের অভাব এখনও স্পষ্ট। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ, হিটস্ট্রোক প্রতিরোধে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং তাপপ্রবাহের সময় স্কুল-কলেজের জন্য বিশেষ নির্দেশনা এখনো জোরালোভাবে কার্যকর হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: কী করা দরকার?
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আগাম সতর্কতা ও তাৎক্ষণিক প্রস্তুতিও জরুরি। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “তাপপ্রবাহ শ্রমজীবী মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। দীর্ঘ সময় গরমে কাজ করার ফলে তাদের শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দেয়, উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কৃষির ওপরও এই প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এজন্য শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়, নগর ব্যবস্থাপনাকে সহনশীল করতে হবে।”
একজন পরিবেশ গবেষক বলেন, “গেল বছরের ভয়ংকর এপ্রিল আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়ে গেছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে, ভবন নির্মাণে প্রতিফলক কাচ (থাই গ্লাস) ব্যবহারের প্রবণতা কমানো, নগরীর কংক্রিটের আধিক্য কমিয়ে সবুজায়ন বাড়ানো এবং জলাধারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা দরকার।
এসব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি, তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে নগরীর গরমের স্পটগুলোতে পানি ছেটানো, শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, এবং হাসপাতালগুলোকে হিটস্ট্রোক রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখা জরুরি।”
বিশ্বব্যাপী তাপপ্রবাহের বিষয়ে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেলের (IPCC) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ায় তাপপ্রবাহের তীব্রতা বেড়েছে, পাশাপাশি শীতের তীব্রতা কমেছে। আগামী দশকগুলোতেও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
জনগণের করণীয়: কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যায়?
তাপপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সাধারণ মানুষেরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রচুর পানি পান করা, সরাসরি সূর্যের তাপ এড়িয়ে চলা, হালকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরা এবং খাবারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাদের দীর্ঘ সময় রোদে থাকতে হয়, তাদের উচিত বারবার বিশ্রাম নেওয়া এবং পর্যাপ্ত পানি খাওয়া।
বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। স্কুল ও অফিসগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মক্ষেত্রে গরমের সময় কাজের সময়সূচি কিছুটা পরিবর্তন করা হলে তাপপ্রবাহের প্রভাব কিছুটা কমানো সম্ভব হতে পারে।
শেষ কথা
তাপপ্রবাহের তীব্রতা বাংলাদেশে প্রতি বছরই নতুন মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে। অথচ প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতির অভাব এখনও স্পষ্ট। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
আপনার এলাকায় তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আপনি নিজে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন? নিচে কমেন্ট করে আপনার মতামত জানান এবং সচেতনতা বাড়াতে এই পোস্টটি শেয়ার করুন!