সুন্দরবনের মধু চুরির বর্তমান অবস্থা
সুন্দরবনে এখন ফুল ফোটার মৌসুম। খলিশা, গরানসহ বিভিন্ন গাছে ফুল ফুটছে, যা মৌমাছিদের জন্য প্রধান মধু সংগ্রহের উৎস। সাধারণত, বন বিভাগ ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত নির্দিষ্ট মৌসুমে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহের অনুমতি দেয়। কিন্তু মৌসুম শুরুর আগেই কিছু অসাধু ব্যক্তি মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে অপরিণত চাক কেটে মধু সংগ্রহ করছেন। মৌসুমের আগেই চুরি হচ্ছে সুন্দরবনের মধু
এতে মৌয়ালরা আশঙ্কা করছেন, মৌসুমের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মধু পাওয়া যাবে না। কারণ অপরিণত চাক কাটার ফলে মৌসুমে পরিপূর্ণভাবে গঠিত চাক কম পাওয়া যায়, যা উৎপাদনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। অপরদিকে, চুরি হওয়া মধুর বাজারদর তুলনামূলক বেশি হওয়ায় কিছু জেলে সুযোগ কাজে লাগিয়ে আগেভাগে মধু আহরণ করছে, যা বন বিভাগের অনুমোদিত নীতির পরিপন্থী।
চুরি হওয়া মধুর বাজার মূল্য ও মৌয়ালদের ক্ষতি
বর্তমানে সুন্দরবন থেকে চুরি করে আনা মধু ১,১০০ থেকে ১,২০০ টাকা প্রতি কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অথচ, মৌসুমে পরিপূর্ণ চাকে পাঁচ থেকে সাত কেজি মধু পাওয়া যায়, যেখানে চোরাকারবারিদের অপরিণত চাক থেকে মাত্র ৩০০-৫০০ গ্রাম মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এতে মৌসুমের সময় মধুর উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা মৌয়ালদের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
একজন মৌয়ালের পক্ষে নির্দিষ্ট মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণ মধু সংগ্রহ করাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপার্জনের পথ। কিন্তু মৌসুমের আগে মধু চুরি হলে মৌয়ালদের জন্য তা একপ্রকার বিপর্যয় হয়ে দাঁড়ায়। তারা যদি কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে না পারেন, তবে ঋণের বোঝা বেড়ে যায় এবং তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে।
বন বিভাগের অভিযান ও আইনি ব্যবস্থা
সুন্দরবনের আন্দারমানিক টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুল হাসান জানান, সম্প্রতি চুরি করে মধু সংগ্রহের সময় ছয়জনকে আটক করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। বন বিভাগ জানিয়েছে, জনবল সংকট থাকায় কিছু ব্যক্তি চোখ ফাঁকি দিয়ে আগেভাগে মধু আহরণ করলেও, নিয়মিত টহলের মাধ্যমে এ ধরনের অপতৎপরতা রোধের চেষ্টা চলছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, ১৮৮৬ সাল থেকে মধু আহরণের জন্য অনুমতি (পাস) দেওয়ার নিয়ম চালু হয়। অনুমোদিত মৌসুম শুরুর আগে কেউ অবৈধভাবে মধু সংগ্রহ করলে তার পারমিট বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর প্রভাব
সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব
সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যেখানে মৌমাছিরা পরাগায়ন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আগাম মধু চুরি করা হলে মৌমাছির সংখ্যা কমে যেতে পারে, যা ফুলের পরাগায়ন ব্যাহত করবে। অপরিণত চাক কাটার ফলে মৌমাছির বসবাসের স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস হতে পারে এবং মধুর প্রাকৃতিক উৎপাদন কমে গিয়ে বনজ সম্পদের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংযোগ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে আগের তুলনায় ঝড়-বৃষ্টি ও লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে। এতে অনেক গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং মধুর মৌসুমে পরিবর্তন আসতে পারে। আগাম মধু চুরি হলে মৌসুম অনুযায়ী ফুল থেকে মধু আহরণ সম্ভব হবে না, ফলে মৌমাছিরা কম মধু উৎপাদন করবে। একইসঙ্গে বন বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে এবং সুন্দরবনের সামগ্রিক জলবায়ু ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বন বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা ও ক্রমহ্রাসমান মধু উৎপাদন
বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুন্দরবনে মধু উৎপাদনের হার ক্রমাগত কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৪,৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় ৩,০০৮ কুইন্টালে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে ২,৮২৫ কুইন্টাল হয় এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৩,১৮৩ কুইন্টালে দাঁড়ায়।
বিগত কয়েক বছরে মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আগাম মধু চুরি। চুরি হওয়া মধু বন বিভাগের হিসাবের বাইরে থাকে, ফলে সরকারি রাজস্ব আয়ও কমে যায়। মৌসুমের আগেই চুরি হচ্ছে সুন্দরবনের মধু
কী করা যেতে পারে?
সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে অবৈধভাবে কেউ মধু সংগ্রহ করতে না পারে। মধু সংগ্রহের মৌসুমে অতিরিক্ত বন রক্ষী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা চোরাকারবারিদের ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে এগিয়ে আসে।
প্রযুক্তির সাহায্যে বন রক্ষায় নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে। ড্রোন ও সিসিটিভি ব্যবহার করে অবৈধ প্রবেশ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। অনুমোদিত মৌয়ালদের জন্য জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
স্থানীয় জনগণের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করাও গুরুত্বপূর্ণ। মৌয়ালদের সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা প্রদান করা হলে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে এবং অবৈধ উপায়ে মধু সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ হবে না। এছাড়া, বন সংরক্ষণে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
শেষ কথা
সুন্দরবনের মধু শুধুমাত্র একটি পণ্য নয়; এটি সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান ও জলবায়ুর ভারসাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আগাম মধু চুরির ফলে শুধু মৌয়ালরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, বরং পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বন বিভাগের কার্যকর উদ্যোগ, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা এবং প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারই পারে এই চুরি বন্ধ করতে এবং সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতে।
আপনার মতামত দিন!
আপনার এলাকায় এ ধরনের বনসম্পদ লুটের ঘটনা ঘটছে কি? আপনি কী ধরনের পদক্ষেপ আশা করেন? মন্তব্য করুন ও শেয়ার করুন, যাতে সবাই সচেতন হয়!