30.9 C
Bangladesh
সোমবার, জুন ২৩, ২০২৫
spot_img

জুমের আগুন : পাহাড়ের বুক ফেটে হাহাকার

জুমের আগুন : সবুজ পাহাড়ের নীরব কান্না

সবুজে ঢাকা পাহাড়। শীতের শেষে গাঢ় সবুজের মাঝে লুকিয়ে থাকা নিরব সৌন্দর্য। কিন্তু হঠাৎই বদলে যায় সেই চিত্র। জুমের আগুনে লেলিহান শিখায় জ্বলতে শুরু করে পাহাড়ের বুক। পার্বত্য এলাকার খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অসংখ্য টিলা ও পাহাড় যেন একেকটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল — এই কয়েক মাস পাহাড় যেন আগুনের রাজ্যে পরিণত হয়। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলে তার প্রাণ। জুমের আগুন

জুম চাষের জন্য এই আগুন লাগানো পাহাড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায় হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি। ধ্বংস হয় নানা ধরনের জীববৈচিত্র্য, যাদের অস্তিত্ব পাহাড়ের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তাদের হাহাকার কোথাও পৌঁছায় না। আগুন নেভার পরে দেখা যায় এক বুক কালো ছাই, মৃতপ্রায় জমি আর শূন্য প্রকৃতি।

পাহাড়ের জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি

জুমের আগুনে শুধু গাছপালা নয়, বিনাশ ঘটে লক্ষ কোটি জীবনের। ছোট বড় কীটপতঙ্গ, পাখি, বন্যপ্রাণী, এমনকি মাটির অণুজীব পর্যন্ত আগুনের লেলিহান গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যায়। এই অণুজীবগুলোই মাটিকে উর্বর রাখত, পাহাড়ের জীবনের চক্র সচল রাখত। আগুনের তাপে পুড়ে মৃত হয়ে যায় পাহাড়ের বুকের সেই প্রয়োজনীয় প্রাণ।

জীবনের এই নিঃশব্দ বিলোপ এক অদৃশ্য পরিবেশগত সংকট তৈরি করে। আজকের ধ্বংস কাল হয়ে দাঁড়ায় আগামী প্রজন্মের জন্য। একদিকে ধ্বংস হচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল, অন্যদিকে বাড়ছে পাহাড়ের অনুর্বরতা।

মৃত্তিকার ক্ষয় ও পাহাড় ধসের ভয়াবহতা

জুমের আগুন যখন বারবার পাহাড়ের গায়ে লেগে ওঠে, তখন মাটির ওপরের উর্বর স্তর — টপসয়েল — ধ্বংস হয়ে যায়। প্রচণ্ড তাপে মাটি শুকিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় ফাটল। সেই ফাটলে বর্ষার পানির প্রবাহে শুরু হয় ভয়ংকর পাহাড় ধস। জুমের আগুন

প্রতিবছর বর্ষায় পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় ধসের ভয়াবহতা দেখা যায়। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যায় ধ্বংসযজ্ঞ। ঢেকে যায় ছড়া-ঝরনা, নদ-নদী। উর্বর টপসয়েল বয়ে গিয়ে মাটি হয়ে পড়ে অনুর্বর। অথচ এই মাটির স্তর তৈরি হতে সময় লাগে শত শত বছর।

পাহাড় ধস শুধু পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, মানুষের জীবনের ওপরও নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। প্রাণহানি, ঘরবাড়ি হারানোর কষ্ট যেন এই এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে।

বিকল্প পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা

জুম চাষ পার্বত্য অঞ্চলের হাজার বছরের ঐতিহ্য হলেও বর্তমান বাস্তবতায় আগুন নির্ভর এই পদ্ধতি পরিবেশের জন্য এক বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে একই জমিতে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব — তাও আবার প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করেই।

শুকনো গাছ-গাছলা জমিয়ে রেখে জৈব সার তৈরি, টপসয়েল সংরক্ষণ, পাহাড়ে নতুন গাছ রোপণ — এসব উদ্যোগ শুধু পরিবেশই রক্ষা করবে না, জুমিয়া পরিবারগুলোকেও টেকসই কৃষির পথ দেখাবে।

তবে এর জন্য দরকার সচেতনতা, প্রশিক্ষণ, এবং যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। কারণ জীবনের প্রয়োজনে, পেটের দায়ে পাহাড়ি পরিবারগুলো বাধ্য হয় বারবার এই বিপজ্জনক পদ্ধতি অবলম্বন করতে।

সরকারের উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ করণীয়

পরিবেশ রক্ষা করতে হলে শুধু নিষেধাজ্ঞা বা আইনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বরং প্রয়োজন জুমচাষীদের জীবন-জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উচিত এই পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক চাষাবাদ শেখানো, বিকল্প কৃষি প্রযুক্তি সরবরাহ করা এবং তাদের জীবনমান উন্নয়ন করা।

জুমের আগুনে পুড়তে থাকা এই সবুজ পাহাড় আমাদের দেশের পরিবেশের জন্য এক বড় সতর্কবার্তা। সময় থাকতে পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে পরিবেশগত বিপর্যয় আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

শেষ কথা : প্রকৃতি বাঁচলে পাহাড় বাঁচবে, পাহাড় বাঁচলে আমরা বাঁচবো

জুমের আগুনে পুড়ছে সবুজ পাহাড় — এই দৃশ্য শুধু পাহাড়ের নয়, আমাদের সবার জন্যই এক গভীর বেদনার প্রতীক। পাহাড়ের কান্না, জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস, মৃত্তিকার ক্ষয় — সব মিলিয়ে পরিবেশের ওপর এক বড় সংকটের ছাপ।

এখনই সময় এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয়, বরং প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের পথ খুঁজে নিতে হবে। পাহাড়ের জীবন ও প্রকৃতি রক্ষায় আমাদের সবার সচেতনতা, সহযোগিতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন।

Call to Action:

আপনার মতামত কী এই সংকট নিয়ে? পরিবেশ রক্ষায় আপনার কী পরামর্শ? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। পরিবেশ সচেতন এই বার্তা ছড়িয়ে দিন অন্যদের মাঝেও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ