বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গে ইলিশ মাছের গুরুত্ব বরাবরই আলোচিত। ইলিশ শুধু বাংলাদেশের জাতীয় মাছই নয়, দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ এবং খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাই সরকার প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন করে থাকে। এবছরও ৮ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ-২০২৫‘ সারা দেশে পালন করবে সরকার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগ ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি, জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামগ্রিকভাবে পরিবেশ রক্ষায় এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ
জাটকা সংরক্ষণ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
জাটকা হলো ছোট আকৃতির ইলিশ, যা এখনও পুরোপুরি বড় হয়নি। এগুলোর দৈর্ঘ্য সাধারণত ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের কম হয়। এই জাটকা যদি ধরা না হয় এবং তাদের বড় হতে দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ইলিশের উৎপাদন বহুগুণে বাড়বে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছেন, ইলিশের উৎপাদন বাড়লে সরবরাহ বাড়বে, বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং দেশের সাধারণ মানুষ সহজে তাদের সাধ্যের মধ্যে ইলিশ কিনতে পারবে।
পরিবেশ ও জলবায়ুর সঙ্গে এর সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। নদী ও সাগরের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে এবং জলজ সম্পদ সুরক্ষায় জাটকা সংরক্ষণ অপরিহার্য। ইলিশ শুধু মাছ নয়, এটি দেশের নদী-মোহনার ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ
সরকারের পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা
সরকার শুধু আইন করে জাটকা ধরা বন্ধ রাখছে না, বরং এই সময়ে জেলেদের জীবনধারণের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তার ব্যবস্থাও নিয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭১টি জেলে পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি হারে মোট ২৮ হাজার ৮৮৫ টন চাল সহায়তা হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া মা ইলিশ রক্ষার মৌসুমে আরও ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৫টি পরিবারকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, জেলেদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বকনা বাছুর, ফিশিং নেট, ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য উপকরণসহ নানা সহায়তা প্রদান করছে। এই পদক্ষেপ জেলেদের জীবিকা রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই মাছ ধরার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সাহায্য করছে।
বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদনের বৈশ্বিক অবস্থান
বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি আসে বাংলাদেশের নদী, মোহনা ও সাগর থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ২৯ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে, যা দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১১ শতাংশ এবং জিডিপিতে ১ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখছে।
এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হলেও, এই সম্পদ রক্ষার দায়িত্বও আমাদের সবার। কারণ ইলিশ যদি বিলুপ্তির পথে চলে যায়, তাহলে তা পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, জেলেদের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
২০২৫ সালের জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের আয়োজন
এবছর ‘জাটকা ধরা বন্ধ হলে, ইলিশ উঠবে জাল ভরে’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ৮ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ২০টি ইলিশসমৃদ্ধ জেলায় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপিত হবে। বরিশাল বিভাগের বরিশাল সদর উপজেলার বেলস পার্কে সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং কীর্তনখোলা নদীতে নৌ র্যালির মাধ্যমে এই কর্মসূচি শুরু হবে।
এই উদ্যোগ শুধু সরকারি কর্মসূচিই নয়, এটি একটি পরিবেশ সচেতনতা তৈরির আন্দোলন। নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং দেশের এক অমূল্য সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখার একটি সামাজিক দায়িত্ব।
পরিবেশ, জলবায়ু এবং মানুষের ভূমিকা
জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের গুরুত্ব কেবল সরকার বা মৎস্য বিভাগেই সীমাবদ্ধ নয়। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও এখানে অত্যন্ত জরুরি। নদী, সাগর বা মোহনার মাছ ধরার নিয়ম মেনে চলা, সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশু ইলিশ না ধরা—এসব নিয়ম মানতে পারলে পরিবেশের ওপর আমাদের ইতিবাচক প্রভাব ফেলা সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, পানি দূষণ, অতিরিক্ত মাছ ধরা —এসব কারণে ইলিশের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই ইলিশ রক্ষায় আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভূমিকা অপরিহার্য।
শেষ কথা
৮ থেকে ১৪ এপ্রিল জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন করবে সরকার—এটি শুধু একটি সরকারী ঘোষণা নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার বার্তা। পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায়, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা টিকিয়ে রাখতে জাটকা সংরক্ষণ অপরিহার্য।
এই উদ্যোগে আমাদের প্রত্যেকের অংশগ্রহণই পারে বাংলাদেশকে ইলিশ সমৃদ্ধ, পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই এক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে। আসুন, আমরা সবাই সচেতন হই, পরিবেশকে ভালোবাসি, এবং ইলিশ রক্ষায় সরকারের পাশে দাঁড়াই।
Call to Action:
আপনি কি মনে করেন জাটকা সংরক্ষণে আমরা সবাই আরও কীভাবে অবদান রাখতে পারি? আপনার মতামত আমাদের কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হই, ইলিশ রক্ষায় এগিয়ে আসি।