বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় একটি মানবিক পদক্ষেপ
একটি অবাক করা আগমন
পঞ্চগড়ের ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা চাকলাহাট ইউনিয়নের প্রধান পাড়া গ্রামের লোকজন কয়েকদিন আগেও হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি তাদের ফসলের খেতে ছুটে বেড়াবে একটি বিরল ও রাজকীয় বন্য প্রাণী—নীলগাই। বুধবার দুপুরে ফসলের খেতে ছুটোছুটি করতে থাকা প্রাণীটিকে দেখে কেউ ভেবেছেন হরিণ, কেউবা ঘোড়া। ধীরে ধীরে শতাধিক মানুষ একত্রিত হয়ে প্রাণীটির পেছনে ছুটতে শুরু করলে এটি পলায়ন করে পাঙ্গা নদীতে ঝাঁপ দেয়। শেষে সেটিকে ঘিরে ফেলে ধরা হয় এবং পরে জানা যায়, এটি একটি স্ত্রী নীলগাই। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে নীলগাই
উদ্ধারের পরের গল্প
প্রাণীটিকে প্রথমে উদ্ধার করে বিজিবির জয়ধরভাঙ্গা বিওপির সদস্যরা। এরপর বন বিভাগের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আহত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া নীলগাইটিকে নিয়ে যাওয়া হয় পঞ্চগড় সদর উপজেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তিন দিন ধরে বন বিভাগ অফিসের একটি নিরাপদ কক্ষে রেখে তাকে খাওয়ানো হয় নেপিয়ার ঘাস, কাঁঠালপাতা, পানিসহ অন্যান্য খাবার। বন বিভাগ জানায়, নীলগাইটি সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে এসেছে এবং কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পেয়েছে।
নিরাপদ আশ্রয়ের পথে যাত্রা
তিন দিন পর শনিবার সন্ধ্যায় কাঠের বিশেষ খাঁচায় ভরে ট্রাকে করে কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে পাঠানো হয় নীলগাইটিকে। একইসঙ্গে গাজীপুরের সাফারি পার্ক থেকে আরেকটি পুরুষ নীলগাই একই ট্রাকে যুক্ত হয়ে যায়। ডুলাহাজারায় তাদের একত্রে উন্মুক্ত পরিবেশে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যাতে তারা একটি অনুকূল পরিবেশে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে নীলগাই
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, “প্রাণীটির শারীরিক অবস্থা ভালো রয়েছে, কেবল কয়েকটি আঁচড় পাওয়া গেছে। এটি একটি সুন্দর ও সচল স্ত্রী নীলগাই, যার জন্য আমরা সঙ্গী হিসেবে একটি পুরুষ নীলগাইও সংগ্রহ করছি।”
নীলগাই: এক হারাতে বসা প্রাণী
নীলগাই (Boselaphus tragocamelus) ভারত উপমহাদেশের একটি স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যাওয়া তৃণভোজী প্রাণী। এটি বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বললেই চলে। বর্তমানে সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাঝে মাঝে এই প্রাণীর দেখা মিললেও তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিকে থাকতে পারেনি। তাই এমন একটি প্রাণীর উদ্ধার এবং সংরক্ষণ প্রকৃত অর্থেই এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ সংরক্ষণমূলক ঘটনা।
পরিবেশ এবং জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব
এই ঘটনার গুরুত্ব শুধুমাত্র একটি প্রাণী উদ্ধারে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাংলাদেশের পরিবেশ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের সামগ্রিক চিত্রকে তুলে ধরে। যখন জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ের মতো সংকট আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন এমন একটি উদ্যোগ আমাদের পরিবেশগত সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দেয়।
জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি প্রাণীর একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। বিশেষ করে তৃণভোজী প্রাণীরা পরিবেশের প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক। এ ধরনের প্রাণীদের পুনর্বাসন কেবল তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে না, বরং আমাদের পরিবেশেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বন বিভাগের ভূমিকা এবং ভবিষ্যৎ করণীয়
পঞ্চগড় বন বিভাগ, বিজিবি এবং সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ এই ঘটনায় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে, আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা থাকলে পরিবেশ সংরক্ষণে সফলতা সম্ভব। তবে ভবিষ্যতে সীমান্ত এলাকায় এরকম প্রাণীর আগমন ঠেকাতে কিংবা তাদের নিরাপদে উদ্ধার করতে আরও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল, প্রযুক্তি এবং নীতিগত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
শেষ কথা
পঞ্চগড় সীমান্তে ধরা পড়া নীলগাইটি কক্সবাজারে পাঠানোর এই ঘটনা আমাদের সচেতন করে তোলে—আমাদের আশপাশেই অনেক কিছু ঘটে চলেছে যা শুধু “সংবাদের” অংশ নয়, বরং পরিবেশের গভীর বার্তা বহন করে। প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদান আমাদের পরিবেশের অঙ্গ। আর সেই পরিবেশ রক্ষাই হোক আমাদের সবার দায়।
আপনিও হতে পারেন পরিবেশরক্ষায় অংশীদার। এই খবরটি শেয়ার করুন, মতামত দিন এবং আমাদের দেশীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগে এগিয়ে আসুন।
#নীলগাই #পরিবেশ #জলবায়ু #সাফারিপার্ক #বাংলাদেশবন্যপ্রাণী