বিশ্বের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রজাতির বিপন্নতার দিকটি প্রতিনিয়ত আলোচনায় আসে। সম্প্রতি, একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলাদেশে দুটি অতি বিপন্ন প্রজাতি—উল্লুক (Western Hoolock Gibbon) এবং চশমাপরা হনুমান (Phayre’s Langur)—এর বিলুপ্তির ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেছে। ‘প্রাইমেটস ইন পেরিল: দ্য ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফাইভ মোস্ট এনডেঞ্জারড প্রাইমেটস’ (২০২৩-২৫) শীর্ষক প্রতিবেদনটি ৮ মে প্রকাশিত হবে এবং এটি পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত প্রদান করছে। বিলুপ্তির পথে উল্লুক ও চশমাপরা হনুমান
এই প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে যে, উল্লুক এবং চশমাপরা হনুমান বাংলাদেশে বিলুপ্তির পথে এবং এই প্রাণীগুলি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও গবেষণার প্রতি অধিক মনোযোগের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রাইমেটের সংকট: কেন এই দুটি প্রাণী বিলুপ্তির পথে?
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বাস করা উল্লুক ও চশমাপরা হনুমান বর্তমানে সঙ্কটজনক অবস্থায় রয়েছে। এটি একটি বিস্তৃত সমস্যা, যেখানে বনভূমির ধ্বংস, শিকার, পাচার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য মানবসৃষ্ট বিপদগুলোর কারণে এই দুটি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে চলে এসেছে। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এসব প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে এবং তাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। বিলুপ্তির পথে উল্লুক ও চশমাপরা হনুমান
উল্লুক ও চশমাপরা হনুমানের জীবনযাত্রা
উল্লুক (Western Hoolock Gibbon):
উল্লুক বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সীমান্তবর্তী বনে বাস করে। এটি মূলত গাছের ওপর থাকে এবং তার প্রধান খাদ্য গাছের পাতা। সিলেটের বনাঞ্চলে ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, উল্লুকের সংখ্যা মাত্র ৪৬৮টি অবশিষ্ট রয়েছে, যা ১৯৮০ সালের ৩,০০০ থেকে কমে এসেছে। এছাড়া, এই অঞ্চলের কিছু বন থেকে উল্লুক পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উল্লুকের জন্য সবচাইতে বড় হুমকি হলো আবাসস্থল ধ্বংস, শিকার, এবং মানবসৃষ্ট বিপদ, যেমন রাস্তায় দুর্ঘটনা বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া।
চশমাপরা হনুমান (Phayre’s Langur):
চশমাপরা হনুমানও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের পশ্চিমাংশে পাওয়া যায়। তবে, এই প্রজাতির সংখ্যাও কমে গেছে। ২০২৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, সিলেটের বনাঞ্চলে মাত্র ৪৮৪টি চশমাপরা হনুমান বেঁচে রয়েছে। এই প্রাণীটি শিকার, পাচার এবং বনভূমির ধ্বংসের কারণে দ্রুত বিলুপ্তির পথে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন: বড় হুমকি
এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তনও এই দুটি প্রজাতির জন্য এক বড় হুমকি। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বনভূমি সংকুচিত হচ্ছে, যার ফলে উল্লুক ও চশমাপরা হনুমানের মতো গাছভিত্তিক প্রাণী তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। অধিকন্তু, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং এর ফলস্বরূপ এই প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
প্রতিবেদনটির গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
প্রতিবেদনটির এক বিশেষ দিক হলো, এটি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। গবেষকরা বলছেন যে, এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, সংরক্ষণ কৌশল, এবং গবেষণা কার্যক্রমে সহায়ক হবে। এই দুই প্রজাতির সংরক্ষণে কেবল জাতীয় স্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। প্রতিবেদনটি সরকারি সংস্থাগুলো এবং এনজিওগুলোকে সচেতন করবে, যাতে তারা সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নেবে।
উল্লুক ও চশমাপরা হনুমান রক্ষা: সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন
বাংলাদেশের বন অধিদপ্তরের প্রধান মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেছেন, “উল্লুক ও চশমাপরা হনুমান সংরক্ষণে একাধিক গবেষণা কার্যক্রম ইতোমধ্যেই চলমান রয়েছে। দ্রুত একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে, যা এই দুই প্রজাতির রক্ষা নিশ্চিত করবে।” তবে, একক উদ্যোগের চেয়ে একাধিক সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টা বেশি ফলপ্রসূ হবে।
প্রধান হুমকি: গাছ না থাকলে প্রাণী টিকে থাকতে পারবে না
গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, উল্লুক ও চশমাপরা হনুমান প্রধানত গাছের ওপর নির্ভরশীল। তাদের খাদ্য গাছের পাতা, এবং তারা এক বন থেকে অন্য বনে যেতে গাছের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করে। তবে, গাছের অভাবে এই প্রাণী দুটি তাদের অস্তিত্ব হারাতে পারে। সুতরাং, একমাত্র সমাধান হল বনভূমি সংরক্ষণ এবং গাছের সংখ্যা বাড়ানো।
সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ
সরকার ইতোমধ্যে উল্লুক ও চশমাপরা হনুমান সংরক্ষণে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। বন অধিদপ্তর এ বিষয়ে ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু করেছে এবং এই প্রজাতির জন্য একটি জাতীয় কর্মসূচি তৈরি করা হচ্ছে। বনভূমি রক্ষা, সামাজিক বনায়ন এবং পরিবেশগত শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে এই প্রাণী দুটি রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।
শেষ কথা: সময় এখনই!
এই দুটি প্রজাতির বিপন্নতা নিয়ে আমরা যত বেশি সচেতন হতে পারব, ততই তাদের রক্ষা নিশ্চিত করতে পারব। জলবায়ু পরিবর্তন, বনভূমি ধ্বংস এবং মানবসৃষ্ট বিপদের ফলে তারা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। তবে, সঠিক সংরক্ষণ কৌশল এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করতে পারে।
আপনার স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পর্কে আরও সচেতন হতে চান? স্বাস্থ্যসেবা বা পরিবেশ রক্ষা সম্পর্কে আরও জানুন এবং আমাদের বিশেষ ডাইজেস্টিভ সাপ্লিমেন্ট সম্পর্কে তথ্য জানুন।
এখনই ব্যবস্থা নিন, পরিবেশ রক্ষায় এবং প্রাকৃতিক জীবনের সুরক্ষায় আপনার ভূমিকা পালন করুন!