উন্নয়ন কি শুধু ইট-পাথরের কাঠামো তৈরি, রাস্তাঘাট বা রেললাইন নির্মাণ? নাকি এর সাথে প্রকৃতির মেলবন্ধন জরুরি? পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উন্নয়নের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। তার মতে, যদি আমরা বন কেটে, পাহাড় কেটে রেললাইন নির্মাণ বা অনুরূপ কর্মকাণ্ডকে উন্নয়ন মনে করি, তবে আমরা নিশ্চিতভাবে ভুল পথে এগোচ্ছি। এই ভুল পথ থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য অপরিহার্য। উন্নয়ন মানে কি প্রকৃতি ধ্বংস
টেকসই উন্নয়ন বনাম প্রকৃতি ধ্বংস
রিজওয়ানা হাসান এই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেন বুধবার (১৪ মে) ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘ইন্ট্রোডাকশন টু ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ইন্সট্রুমেন্ট ফর ক্লাইমেট ফিন্যান্স’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং উন্নয়নের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে গভীর আলোকপাত করেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “উন্নয়ন বরাদ্দ সহযোগিতা যতই আসুক, তা যথেষ্ট হবে না যদি আমরা প্রকৃতিকে সংরক্ষণ না করি, যদি আমরা অভিযোজন এবং প্রশমন উভয় ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করি।” এর মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করেন যে, শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা টেকসই উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়; বরং প্রকৃতির নিজস্ব যে শক্তি, যা আমাদের দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে, তাকে রক্ষা করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ (অভিযোজন) ও কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার (প্রশমন) জন্য বিনিয়োগ করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন মানে কি প্রকৃতি ধ্বংস
জলবায়ু অর্থায়ন: দায় এড়ানো হচ্ছে কি?
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর দায়বদ্ধতা নিয়ে রিজওয়ানা হাসান তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘ চুক্তি (UNFCCC) এবং প্যারিস চুক্তির অধীনে উন্নত দেশগুলোর যে-সব দেশে (বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ) অর্থ দেওয়ার কথা, তারা এখন প্রকৃতিনির্ভর সমাধানের কথা বলছে অথচ প্রকৃত অর্থ বরাদ্দ করছে না। উন্নত দেশগুলো বলছে, তোমরা নিজেদের প্রস্তুত করো, প্রকৃতি রক্ষা করো, যাতে দুর্যোগে টিকে থাকতে পারো। কিন্তু রিজওয়ানা হাসানের মতে, এর মাধ্যমে তারা প্রকারান্তরে নিজেদের ঐতিহাসিক দায় কমিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর দায় চাপাচ্ছে।
তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, এটি কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে সামান্যই দায়ী, কিন্তু এর ভয়াবহ পরিণতি তাদেরই বেশি ভোগ করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থায়নের দায় উন্নত দেশগুলোরই নেওয়া উচিত, প্রকৃতি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও তা যেন অর্থায়নের বিকল্প না হয়। উন্নয়ন মানে কি প্রকৃতি ধ্বংস
প্রকৃতি রক্ষায় জরুরি আর্থিক ব্যবস্থাপনা
প্রকৃতি ও বন রক্ষার ক্ষেত্রে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগগুলো (যেমন: বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা) প্রকৃতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে এবং এই ক্ষতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন হয়। ম্যানগ্রোভ বন, উপকূলীয় বনাঞ্চল, পাহাড় ও জলাভূমি—এগুলো প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। এদের রক্ষা করা গেলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো সম্ভব। আর এজন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত আর্থিক পরিকল্পনা এবং জরুরি ভিত্তিতে অর্থায়নের ব্যবস্থা রাখা।
বাংলাদেশের ইতিবাচক পদক্ষেপ: ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ
আশার কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু অর্থায়ন এবং প্রকৃতি রক্ষায় বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে। রিজওয়ানা হাসান জানান, বাংলাদেশ সরকার ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছে। এই প্লাটফর্মে সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি (SIDA), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা সহায়তা করছে। এই ধরনের অংশীদারিত্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অর্থায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে।
তিনি জানান, আমরা চাই, এই প্রক্রিয়াটি ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকরভাবে শুরু হোক। এই সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা সম্পন্ন করা হবে। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে বসতে যাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা যেহেতু একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বিষয়, তাই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। এই প্লাটফর্ম সেই সমন্বয় সাধনে সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়।
উন্নয়ন এবং প্রকৃতির মেলবন্ধন কেন জরুরি?
প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন চিন্তা করাটা অনেকটা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো। বনভূমি ধ্বংস করলে ভূমি ক্ষয় বাড়ে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়, বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হয় এবং কার্বন শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করে। পাহাড় কাটলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। নদী বা জলাভূমি ভরাট করলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এসব কিছুই মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অন্যদিকে, প্রকৃতিকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা গেলে তা দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের পথ খুলে দেয়। সুস্থ বনভূমি বিশুদ্ধ বায়ু সরবরাহ করে, নদী ও জলাভূমি পানীয় জল এবং মাছের মতো সম্পদ দেয়, উপকূলীয় বনভূমি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটনের বিকাশ ঘটায়। তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করা শুধু পরিবেশবাদীদের দায়িত্ব নয়, এটি উন্নয়ন পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত।
আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের এই বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, উন্নয়নের পথ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের আরও অনেক বেশি সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই উন্নয়নের একমাত্র সূচক হতে পারে না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে চাইলে প্রকৃতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সরকার তার নীতি ও পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অংশীদারের সাথে কাজ করছে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবেও অনেক কিছু করতে পারি। যেমন: পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো ত্যাগ করা, টেকসই পণ্যের ব্যবহার বাড়ানো, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে সমর্থন জানানো এবং প্রকৃতি রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করা। স্থানীয় পর্যায়ে গাছ লাগানো, জলাশয় রক্ষা করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা—এসব ছোট ছোট কাজও সামগ্রিকভাবে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
উন্নয়ন এবং পরিবেশ—এই দুটি বিষয়কে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখতে হবে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে অর্জিত তথাকথিত উন্নয়ন কখনো সুখ বা সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারে না। রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য তাই আমাদের জন্য একটি জরুরি আহ্বান—ভুল পথ থেকে ফিরে এসে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান নিশ্চিত করে এমন উন্নয়নের পথে হাঁটা।
শেষ কথা: আপনি কী ভাবছেন?
পরিবেশ রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ এবং উন্নয়নের সংজ্ঞাকে নতুন করে ভাবা নিয়ে আপনার কী মতামত? প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নয়নকে আপনি কীভাবে দেখেন? আমাদের কমেন্ট করে জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিন। আপনার সচেতনতা অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে।
আসুন, সবাই মিলে একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার পথে এগিয়ে যাই।