32.7 C
Bangladesh
শনিবার, জুন ৭, ২০২৫
spot_img

চট্টগ্রাম কি পারবে জলাবদ্ধতাকে শূন্যে নামাতে? প্রধান উপদেষ্টার কঠিন নির্দেশ

বর্ষা এলেই দেশের বড় শহরগুলোর একটি পরিচিত চিত্র হলো জলাবদ্ধতা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা যেন এক দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। প্রতি বছর বর্ষায় এই সমস্যা শুধু জনজীবনকেই বিপর্যস্ত করে না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও মারাত্মক স্থবিরতা নিয়ে আসে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে এবার সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার বার্তা স্পষ্ট: থিওরি নয়, এবার চাই কাজের কাজ, আর চট্টগ্রামকেই হতে হবে জলাবদ্ধতা নিরসনে সারা দেশের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রধান উপদেষ্টার কঠিন নির্দেশ

প্রধান উপদেষ্টার জরুরি নির্দেশনা: অর্ধেকে নামিয়ে আনুন, শূন্যে পৌঁছান

বুধবার (১৪ মে) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা এই কঠোর নির্দেশনা দেন। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন এবং অন্যান্য সেবা সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন এবং তাদের উদ্যোগ ও অভিজ্ঞতা শোনেন। প্রধান উপদেষ্টার কঠিন নির্দেশ

প্রফেসর ইউনূস বলেন, “আমরা অনেক রকম থিওরিটিক্যাল আলোচনা করেছি। সেসব আর করতে চাই না। আমরা চাই জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে চিরতরে বের হয়ে আসতে। কিন্তু সেটা একবারেই হবে না, তাই আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।” তার এই বক্তব্য দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও তাত্ত্বিক আলোচনার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের উপর জোর দেয়। তিনি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেন, চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতাকে আগের তুলনায় অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে এই সমস্যাকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।

এই বর্ষার গুরুত্ব: পরীক্ষা ও প্রত্যাশা

প্রধান উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন যে বর্ষা মৌসুম ইতোমধ্যে এসে গেছে, তাই এবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি গত কয়েক মাসে সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের অন‍্যান‍্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে বলেন, “গত কয়েক মাসে সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের অন‍্যান‍্য প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাতে যদি এবছর যদি তারা আশানুরূপ ফল না আসে তাহলে তো সবকিছু মনে হবে জলে গেল।”

এই কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে এবারের বর্ষার মূল গুরুত্ব। বিভিন্ন সংস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে, বেশ কিছু মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের যে প্রচেষ্টা চলছে, তার ফল এই বর্ষায় দৃশ্যমান হওয়া চাই। যদি দৃশ্যমান উন্নতি না হয়, তাহলে বুঝতে হবে কোথাও মৌলিক গলদ রয়েছে অথবা প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত নয়। তাই এবারের বর্ষা চট্টগ্রামের জন্য শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের মৌসুম নয়, এটি কর্তৃপক্ষের কাজের একটি অগ্নিপরীক্ষাও বটে।

চট্টগ্রামকে কেন দৃষ্টান্ত হতে হবে? সক্ষমতা ও প্রতীকী গুরুত্ব

প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক অর্জন এবং সক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, “চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে একটি প্রতীকী সমস‍্যা এবং খুবই জটিল সমস্যা। এই সমস‍্যা নিরসনের মাধ্যমে অন‍্যান‍্য শহর ও জেলা উৎসাহিত হবে। তাই চট্টগ্রামকে এই কাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে।”

কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং প্রধান সমুদ্র বন্দর হওয়ায় চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। এই শহরের জলাবদ্ধতা দেশের অর্থনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদি চট্টগ্রাম তার এই দীর্ঘদিনের জটিল সমস্যা সমাধান করতে পারে, তবে তা শুধু চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভোগই লাঘব করবে না, এটি দেশের অন্যান্য শহর ও জেলাগুলোর জন্যও একটি মডেল বা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে। কীভাবে একাধিক সংস্থা একসাথে কাজ করে, কীভাবে নাগরিক সমাজ যুক্ত হয় এবং কীভাবে একটি জটিল ও পুরনো সমস্যার সমাধান সম্ভব – তার একটি উদাহরণ তৈরি হবে। প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বাস করেন, চট্টগ্রামের যে সক্ষমতা রয়েছে, অনেক শহরের তা নেই। তাই এই সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা পারে।

জটিলতার আড়ালে: সমস্যাগুলো আসলে কী?

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা কেন এত জটিল? এর পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ:

  1. প্রাকৃতিক কারণ: চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান এবং উঁচু-নিচু topography পানি নিষ্কাশনকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। অতিবৃষ্টি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে, পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে।
  2. খাল ও নালা দখল: শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বহু খাল ও প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন পথ বছরের পর বছর ধরে দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে। এতে পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
  3. অপরিকল্পিত নগরায়ন: দ্রুত নগরায়নের ফলে অনেক জলাশয় ও নিচু ভূমি ভরাট করে ফেলা হয়েছে, যা বৃষ্টির পানি জমার এলাকাগুলো নষ্ট করে দিয়েছে।
  4. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: কঠিন বর্জ্য (বিশেষ করে পলিথিন ও প্লাস্টিক) ড্রেন ও খালগুলোতে জমে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল করে দেয়।
  5. বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা: জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (সিসিসি), পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসা ইত্যাদি একাধিক সংস্থা জড়িত। প্রায়শই এদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়, যা কাজের গতি কমিয়ে দেয়।
  6. মেগা প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা: জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে, যার ফলে সুফল পেতে দেরি হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা যখন “জটিল সমস্যা” বলছেন, তখন আসলে এই সবগুলো কারণকেই ইঙ্গিত করছেন। এই সমস্যাগুলো রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়, তবে সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর সমন্বয় এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টা থাকলে অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব।

সক্ষমতার প্রমাণ এবং নাগরিক সমাজের ভূমিকা

প্রফেসর ইউনূস চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে বলেছেন। এর অর্থ হলো, শুধু বরাদ্দ বা প্রকল্প থাকলেই হবে না, সেগুলোকে সময়মতো ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। দুর্নীতিরোধ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এই সক্ষমতা প্রমাণের একটি বড় অংশ।

একই সাথে তিনি নাগরিক সমাজের “বলিষ্ঠ ভূমিকা” রাখার উপর জোর দিয়েছেন। নাগরিক সমাজ কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?

  1. সচেতনতা বৃদ্ধি: জলাবদ্ধতার কারণ ও সমাধানের উপায় সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।
  2. নিয়ম মেনে চলা: যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকা, ড্রেন ও খাল পরিচ্ছন্ন রাখতে সহযোগিতা করা।
  3. কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়া: সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষকে উৎসাহিত করা এবং নিষ্ক্রিয়তার ক্ষেত্রে জবাবদিহি চাওয়া।
  4. স্বেচ্ছাশ্রমে অংশগ্রহণ: স্থানীয় পর্যায়ে ড্রেন পরিষ্কার বা বর্জ্য অপসারণের মতো কাজে যুক্ত হওয়া।
  5. তথ্য সরবরাহ: জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে কর্তৃপক্ষকে জানানো।

নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু সরকারি উদ্যোগ দিয়ে এই বিশাল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের দৃষ্টিকোণ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে জলাবদ্ধতার সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন আসছে। অল্প সময়ে ভারি বৃষ্টিপাত এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় শহরগুলোতে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিও নিচু এলাকার পানি নিষ্কাশনকে বাধাগ্রস্ত করছে।

পরিবেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, খাল ও জলাভূমি ভরাট করে নগরায়ন প্রকৃতির স্বাভাবিক পানি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। নির্বিচারে বর্জ্য ফেলা নদী ও খালকে বিষাক্ত করে তুলছে, যা জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। তাই জলাবদ্ধতা নিরসন শুধু একটি নগর ব্যবস্থাপনা সমস্যা নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়েরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্পন্ন করতে পারব। প্রধান উপদেষ্টার কঠিন নির্দেশ

অন্যান্য উপদেষ্টাদের উপস্থিতি

মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টার সাথে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা সি. আর আবরার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম, প্রধান উপদেষ্টার স্পেশাল এনভয় লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। উচ্চ পর্যায়ের এতজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে।

শেষ কথা: দৃষ্টান্ত কি তৈরি হবে?

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই নির্দেশনা চট্টগ্রামের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ এবং একই সাথে একটি সুযোগ। চ্যালেঞ্জ হলো দীর্ঘদিনের এই জটিল সমস্যাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দৃশ্যমানভাবে কমানো। সুযোগ হলো, এই সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সারা দেশের জন্য একটি সফল মডেল তৈরি করা, যা অন্যান্য শহরগুলোকেও তাদের অনুরূপ সমস্যা সমাধানে অনুপ্রাণিত করবে।

এই কাজ সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন হবে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার মধ্যে অভূতপূর্ব সমন্বয়, চলমান প্রকল্পগুলোর দ্রুত ও সঠিক বাস্তবায়ন, দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি চট্টগ্রামবাসীর সক্রিয় সহযোগিতা। শুধু থিওরি বা পরিকল্পনায় আটকে না থেকে বাস্তবে কাজ করে দেখানোই এখন মুখ্য।

চট্টগ্রাম কি পারবে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে? এই প্রশ্নটির উত্তর নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ – সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সেবা সংস্থা এবং সর্বোপরি চট্টগ্রামবাসী – তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছার ওপর। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের সুরক্ষায় এই দৃষ্টান্ত স্থাপন এখন সময়ের দাবি।

আপনারাও অংশ নিন: চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে আপনার কী মনে হয় সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার? নাগরিক হিসেবে আমরা কীভাবে এই কাজে সহযোগিতা করতে পারি? আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্ট করে জানান এবং এই আলোচনায় অংশ নিন। প্রধান উপদেষ্টার কঠিন নির্দেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ