গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের মধ্যেই এক ভয়াবহ দৃশ্যের সাক্ষী হলো চাঁদপুরের মতলব উত্তরের মেঘনা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীর তীরে শুধু মরা মাছ আর জলজ প্রাণী ভেসে উঠেছে, যা দেখতে যেমন মর্মান্তিক, তেমনি তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বড়সড় বিপদ সংকেত। গত কয়েক দিন ধরে এই ঘটনা ঘটছে, আর মরা মাছ পচে চারপাশে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ। ঝাঁকে ঝাঁকে মরা মাছ কেন ভাসছে
এই দৃশ্য কেবল কিছু মরা মাছের ছবি নয়; এটি আমাদের নদীগুলোর দুর্দশা, লাগামহীন দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে পরিবেশের নাজুক অবস্থার এক জীবন্ত প্রমাণ।
এক বিমর্ষকর দৃশ্য: মরা মাছের মিছিল মেঘনার তীরে
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে মেঘনার পরিচিত সবুজ পানির রং পাল্টে কালচে ও ঘোলাটে হয়ে গেছে। আর সেই পানির ওপর আর তীরে শুধু মরা প্রাণীর ভিড়। লাল চেউয়া, সাদা চেউয়া, বেলে, সেলেং, চাপিলা, চিংড়ি, কাঁচকি, জাটকাসহ ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠেছে। মাছের পাশাপাশি ব্যাঙ, কুচি এমনকি জলসাপের মতো জলজ প্রাণীও রেহাই পায়নি এই মৃত্যু মিছিল থেকে।
নদীর তীরে মরা মাছ ও প্রাণীর স্তূপ হয়ে আছে, যা পচে-গলে এক অসহ্য দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই দুর্গন্ধ এতটাই তীব্র যে নদীর তীরবর্তী পাঁচ ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা নাকাল হয়ে পড়েছেন। বাতাস ভারি হয়ে আছে পচা গন্ধ আর দূষণের ভারে। ঝাঁকে ঝাঁকে মরা মাছ কেন ভাসছে
কেন এই গণমৃত্যু? দূষণই কি একমাত্র কারণ?
স্থানীয় পর্যায়ে যারা নদীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা বলছেন এই ভয়াবহ অবস্থার পেছনের মূল কারণ হলো upstream (উজান) থেকে আসা কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য। ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকার বর্জ্য শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে মেঘনার পানিতে মিশে যাচ্ছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বর্জ্য পানিতে মিশে গেলে পানির গুণগত মান মারাত্মকভাবে খারাপ হয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, দূষণ বেড়ে যাওয়ায় মেঘনার পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে মাছ ও জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ এবং পানির পিএইচ (pH) কমে গেছে। পানিতে অক্সিজেন আর পিএইচের মাত্রা কমে গেলেই জলজ প্রাণীর শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং তারা মারা যেতে শুরু করে। অ্যামোনিয়ার মতো বিষাক্ত উপাদানও মাছের মৃত্যুর কারণ হয়। ঝাঁকে ঝাঁকে মরা মাছ কেন ভাসছে
এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, গত বছরের আগস্ট মাসেও একই রকমভাবে মেঘনায় বিপুল পরিমাণ মাছ ও জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠেছিল। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে দূষণের সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী এবং এর সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ আর নদীর সংকট
যদিও তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে শিল্প বর্জ্যকেই চিহ্নিত করা হচ্ছে, তবে এই ধরনের ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পরিবেশের সামগ্রিক নাজুক অবস্থাকেই তুলে ধরে। নদীগুলো এমনিতেই দূষণ, দখল আর নাব্যতা সংকটে বিপর্যস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা অন্যান্য চরম আবহাওয়ার ঘটনা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে আরও দুর্বল করে তোলে।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি: গরমকালে এমনিতেই নদীর পানির তাপমাত্রা বাড়ে। তাপমাত্রা বাড়লে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এর ওপর যদি বিষাক্ত বর্জ্য মেশে, তাহলে অক্সিজেনের ঘাটতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে, যা মাছের মৃত্যুর কারণ হয়।
- শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কম: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে অনেক নদীর পানির প্রবাহ কমে যায়। প্রবাহ কম থাকলে কলকারখানার বর্জ্য পানিতে মিশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে না, ফলে দূষণের ঘনত্ব বাড়ে এবং এর প্রভাব আরও মারাত্মক হয়। যদিও মেঘনা একটি বৃহৎ নদী, কিন্তু জোয়ার-ভাটার কারণে upstream-এর দূষণ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- বন্যা ও জলাবদ্ধতা: আবার, ভারী বৃষ্টি বা বন্যার সময় অতিরিক্ত বর্জ্য ধুয়ে নদীতে আসতে পারে, যা দূষণের মাত্রা হঠাৎ করে বাড়িয়ে দিতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে মেঘনায় মরা মাছ ভেসে ওঠার ঘটনা কেবল শিল্প দূষণের সমস্যা নয়, এটি পরিবেশের উপর আমাদের সম্মিলিত অবহেলার ফল, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে আরও মারাত্মক রূপ নিতে পারে। নদীগুলো কেবল মাছের আবাসস্থল নয়, এটি আমাদের পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর ক্ষেত্রেও এর সুস্থতা জরুরি।
জীবনের জন্য লড়াই: দূষিত পানির ব্যবহার ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
নদীর তীরে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষের জন্য এই পরিস্থিতি এক চরম সংকট। পচা মাছের দুর্গন্ধে ঘরে টেকা যেমন দায়, তেমনি দূষিত পানির ব্যবহার তাদের স্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে।
স্থানীয়দের বর্ণনায় উঠে এসেছে করুণ চিত্র। বাধ্য হয়ে অনেকেই নদীর দূষিত পানিই গোসল ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে শিশুদের দূষিত পানিতে গোসল করা বা খেলার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। গত বছরের ঘটনার পরও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে।
কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ ও ভবিষ্যতের পথ
এই ঘটনা জানার পর মৎস্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং পানির গুণগত মান পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষায় পানির দূষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং এর কারণ হিসেবে upstream থেকে আসা বর্জ্যকেই দায়ী করা হয়েছে। গত বছরেও এমন ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল বলে জানা গেছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনা রোধ করতে হলে উৎসস্থলে অর্থাৎ কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যের পরিশোধন (ETP- Effluent Treatment Plant) নিশ্চিত করতে হবে। শুধু আইন থাকলেই হবে না, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন। নদীগুলো যাতে আমাদের শিল্পায়নের ডাস্টবিন না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় এবং নাগরিক দায়িত্ব।
নদী দূষণ বন্ধ করা কেবল জলজ প্রাণীদের বাঁচানোর জন্য নয়, এটি আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যও অপরিহার্য। সুস্থ নদী মানে সুস্থ পরিবেশ, আর সুস্থ পরিবেশ মানে সুস্থ জীবন। জলবায়ু পরিবর্তনের এই কঠিন সময়ে নদীগুলোকে বাঁচানো মানেই নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা।
শেষ কথা:
মেঘনায় ঝাঁকে ঝাঁকে মরা মাছ ও জলজ প্রাণী ভেসে ওঠাটা একটা গুরুতর বিপদ সংকেত। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা আমাদের নদীগুলোর প্রতি কতটা নির্দয় হয়েছি। শিল্প বর্জ্যের এই আগ্রাসন যদি এখনই না থামানো যায়, তাহলে হয়তো একদিন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল ছবিতে দেখবে নদীতে কেমন মাছ সাঁতার কাটত বা জলজ প্রাণী বাস করত।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের নদীগুলোকে সুস্থ রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে হলে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি আমাদের সবার সচেতনতা এবং দায়িত্বশীল আচরণ প্রয়োজন।
আপনার কী মনে হয়? মেঘনার এই ভয়াবহ দূষণ রোধে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি? কলকারখানার বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে আমাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? কমেন্ট করে জানান আপনার ভাবনা।