প্রচণ্ড গরম আর হাঁসফাঁস অবস্থার পর যখন মেঘ জমে বৃষ্টি নামে, তখন মনে হয় প্রাণ ফিরে এল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। বৃষ্টি হচ্ছে, তাপমাত্রা হয়তো কিছুটা কমছে খাতায়-কলমে, কিন্তু বাস্তবে অনুভূত হচ্ছে অস্বস্তিকর ভ্যাপসা গরম। শরীর থেকে যেন চিটচিটে ঘাম বেরোতে চাইছে অবিরত। ফ্যানের নিচে বসলেও বা এসি চালালেও ঠিক যেন স্বস্তি মিলছে না। দেশের অনেক জায়গাতেই এখন এই অদ্ভুত আবহাওয়া চলছে – একদিকে ঝরছে বৃষ্টি, অন্যদিকে তীব্র গরমের অনুভূতি। বৃষ্টি হলেও গরম কেন কমছে না
এ মাসের শুরুতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়েছে অনেক জায়গায়, যা চলতি বছরের অন্য সময়ে দেখা যায়নি। সেই তুলনায় এখন তাপমাত্রা কিছুটা কমেছে, বৃষ্টিও হচ্ছে। তাহলে কেন এই ভ্যাপসা গরমের অনুভূতি? এটা কি শুধু এই সময়ের স্বাভাবিক আবহাওয়া, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশের কোনো জটিল রহস্য?
বৃষ্টি এলেও গরম কেন কাটছে না? আবহাওয়া কী বলছে?
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারীরা এই সময়ের আবহাওয়াকে বিশ্লেষণ করে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন। সাধারণত এপ্রিল ও মে মাসটা আমাদের দেশে কালবৈশাখী ঝড় আর বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। এই সময়টায় আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে।
- কালবৈশাখীর চরিত্র: আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন অংশে বজ্রসহ বৃষ্টি বা কালবৈশাখী হচ্ছে। যখন ঝড় বা বৃষ্টি হয়, তখন মাটির কাছাকাছি থাকা গরম বাতাস উপরে উঠে যায় এবং তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসে। বিশেষ করে রাতের বেলায় বৃষ্টির পর ঠান্ডা অনুভূত হতে পারে।
- দ্রুত মেঘ কেটে যাওয়া: কিন্তু এই সময়টায় বৃষ্টি বা ঝড় খুব বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয় না। মেঘ দ্রুত কেটে যায় এবং আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। বৃষ্টি হলেও গরম কেন কমছে না
- দিনের বেলায় সূর্যের তেজ: একবার মেঘ কেটে গেলে দিনের বেলায় সূর্যের আলো সরাসরি মাটিতে পড়ে এবং ভূপৃষ্ঠ দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। যেহেতু এখন দিনের দৈর্ঘ্য বড়, তাই সূর্য অনেকক্ষণ ধরে তাপ ছড়াতে পারে। এই কারণে দিনের বেলায় তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায় এবং গরম অনুভূত হয়।
- আর্দ্রতার উচ্চ মাত্রা: এখানেই আসে মূল খেলাটা। আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা এবং বাতাসের আর্দ্রতা (পানির পরিমাণ) দুটিই তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। বৃষ্টি হওয়ার পর মাটির তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এই উচ্চ আর্দ্রতার কারণেই ভ্যাপসা গরম অনুভূত হয়। ঘাম সহজে বাষ্প হয়ে উড়তে পারে না, ফলে শরীর ঠান্ডা হতে চায় না এবং অস্বস্তি লাগে।
অর্থাৎ, দিনের বেলায় তীব্র রোদ আর রাতের বা সন্ধ্যার স্বল্পস্থায়ী বৃষ্টির পর বাতাসে বেড়ে যাওয়া জলীয় বাষ্প – এই দুইয়ের মিশেলেই তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত ভ্যাপসা গরমের অনুভূতি। আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক দিন এই পরিস্থিতি বজায় থাকতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের যোগসূত্র কোথায়?
এই ধরনের আবহাওয়ার প্যাটার্ন কি কেবলই মৌসুমী খামখেয়ালিপনা, নাকি এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো ভূমিকা আছে? পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এই ধরনের চরম এবং অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া ঘটনাগুলোকে আরও ঘন ঘন এবং তীব্র করে তুলছে।
- গরম বাতাস বেশি জলীয় বাষ্প ধরে রাখে: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। উষ্ণ বাতাস ঠান্ডা বাতাসের চেয়ে বেশি জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে। যখন বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে, তখন তা আরও বেশি তাপ শোষণ করে এবং ধরে রাখে। এর ফলে পরিবেশ উষ্ণ হয়ে ওঠে এবং ভ্যাপসা গরমের অনুভূতি বাড়ে, এমনকি বৃষ্টি হওয়ার পরও। বৃষ্টি হলেও গরম কেন কমছে না
- বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন আসছে। কোথাও হয়তো বৃষ্টি কম হচ্ছে, কোথাও হঠাৎ করে তীব্র বৃষ্টি বা বন্যা হচ্ছে। আবার কোথাও বৃষ্টি হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না, যেমনটা এখন আমরা দেখছি। স্বল্পস্থায়ী তীব্র বৃষ্টি হয়তো সাময়িকভাবে তাপমাত্রা কমায়, কিন্তু বাতাসে আর্দ্রতা বাড়িয়ে দেয়, যা ভ্যাপসা গরমের কারণ হয়। অন্যদিকে, দীর্ঘস্থায়ী ও মাঝারি বৃষ্টি মাটির তাপমাত্রা কমিয়ে পরিবেশকে শীতল করতে বেশি কার্যকর।
- চরম আবহাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি: তীব্র তাপপ্রবাহ, তারপর স্বল্পস্থায়ী ভারী বৃষ্টি, তারপর আবার ভ্যাপসা গরম – জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো আগের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি বা তীব্র গরম ফসলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, যা খাদ্য সুরক্ষার ওপর প্রভাব ফেলে।
পরিবেশের উপর আমাদের কার্যকলাপ, যেমন কার্বন নিঃসরণ, বন উজাড়, নদী দূষণ – এগুলোই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। যখন আমরা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করি, তখন আবহাওয়াও তার স্বাভাবিক ছন্দ হারায়। বৃষ্টি যখন দরকার, হয়তো তখন হচ্ছে না, আবার যখন হচ্ছে তখন তার ধরন পাল্টে যাচ্ছে।
ভ্যাপসা গরমে জনজীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
বৃষ্টি হওয়ার পরও ভ্যাপসা গরমের কারণে জনজীবনে এক ধরনের অস্বস্তি লেগেই থাকে।
- শারীরিক অস্বস্তি: উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে ঘাম বেশি হয়, শরীর ক্লান্ত লাগে এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। হিট ক্র্যাম্প, হিট এগজশন বা এমনকি হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিও বেড়ে যায়, বিশেষ করে যারা বাইরে কাজ করেন বা শারীরিক পরিশ্রম করেন।
- রোগ জীবাণুর বিস্তার: উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশ রোগ জীবাণু এবং মশা-মাছির বংশবৃদ্ধির জন্য খুব উপযোগী। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া বা অন্যান্য পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি এই সময়ে বেড়ে যেতে পারে।
- ঘুমের ব্যাঘাত: ভ্যাপসা গরমের কারণে রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয়, যা দিনের বেলায় কাজের ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং শরীরকে আরও ক্লান্ত করে তোলে।
নদীর তীরবর্তী কিছু এলাকায় মৃদু তাপপ্রবাহ এখনও চলছে বলে জানা গেছে, যদিও বৃষ্টি বাড়লে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হতে পারে। তবে সার্বিকভাবে ভ্যাপসা গরমের অস্বস্তি সহজে কাটছে না।
কীভাবে এই আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে চলবেন?
জলবায়ু পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা এবং এর প্রভাব রাতারাতি কমবে না। তবে এই পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে:
- প্রচুর পানি পান: ডিহাইড্রেশন এড়াতে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করুন। শুধু পানি নয়, ডাবের পানি, ফলের রস, লেবুর শরবত বা ওরস্যালাইনও পান করতে পারেন।
- হালকা খাবার: তেল-মশলাযুক্ত ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন। সহজপাচ্য ও হালকা খাবার খান, যা শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। ফলমূল ও শাকসবজি বেশি করে খান।
- হালকা পোশাক: ঢিলেঢালা, সুতির হালকা রঙের পোশাক পরুন, যা বাতাস চলাচল করতে সাহায্য করে এবং ঘাম শুষে নেয়।
- বিশ্রাম: দিনের বেলায় যখন গরম বেশি থাকে, তখন বেশি পরিশ্রমের কাজ এড়িয়ে চলুন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
- ঘরের ভেতর ঠান্ডা রাখুন: ঘর ঠান্ডা রাখার জন্য ফ্যান, এসি বা কুলার ব্যবহার করুন। দিনের বেলা সরাসরি রোদ যেন ঘরে না ঢোকে তার ব্যবস্থা করুন।
এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো আপনাকে এই অস্বস্তিকর আবহাওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারে।
শেষ কথা
বৃষ্টি ঝরছে, কিন্তু গরমও লাগছে – আবহাওয়ার এই অদ্ভুত আচরণ জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংকটেরই একটা অংশ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কতটা গভীর এবং পরিবেশের উপর আমাদের কার্যকলাপের প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
এই ভ্যাপসা গরম শুধু একটি সাময়িক অসুবিধা নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ আবহাওয়ার একটি সম্ভাব্য পূর্বাভাস। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যদি আরও চরম আবহাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে হয়, তাহলে এখনই পরিবেশ সুরক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে। কলকারখানার দূষণ কমানো, গাছ লাগানো, পানির অপচয় রোধ করা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো – এই ছোট ছোট কাজগুলোই হয়তো ভবিষ্যতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
বৃষ্টির মধ্যেও ভ্যাপসা গরম নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? এই ধরনের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে চলতে আপনি কী করেন? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পরিবেশ রক্ষায় আর কী কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? কমেন্ট করে জানান আপনার মূল্যবান মতামত।