32.3 C
Bangladesh
শুক্রবার, জুন ৬, ২০২৫
spot_img

মশার উপদ্রব ১২ গুণ বেড়েছে, ডেঙ্গু আতঙ্ক তুঙ্গে!

আজকের আলোচনা শুরু করার আগে, একটু চারপাশে তাকান তো! বিশেষ করে যদি আপনি শহর বা গ্রামে যেখানেই থাকুন না কেন, সন্ধ্যার পর বা ভোরের আগে মশা কি আপনাকে জ্বালিয়ে মারছে না? কয়েল জ্বালিয়ে, স্প্রে করে, মশারি টাঙিয়েও যেন শান্তি নেই। এই যে মশার অসহ্য উপদ্রব, এটি কি কেবলই একটি ছোট সমস্যা? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর কোনো কারণ, যা আমাদের পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত? আসুন, আজকের এই পোস্টে আমরা মশার কামড়ে অতিষ্ঠ জনজীবন, ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান আতঙ্ক এবং এর পেছনের কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করি। ডেঙ্গু আতঙ্ক তুঙ্গে

মশার উপদ্রব: এক অসহ্য বাস্তবতা

ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ এখন মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ। এটি কেবল একটি অনুভূতি নয়, এটি একটি তিক্ত বাস্তবতা। ঘরে, বাইরে, অফিস, স্কুল – কোথাও যেন মশার হাত থেকে নিস্তার নেই। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মশার ঝাঁক যেন আক্রমণ করে। কয়েল আর স্প্রে এখন দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, কিন্তু তাতেও মশা পুরোপুরি দূর হচ্ছে না। মশার সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, গত বছরের তুলনায় এবার মশা প্রায় ১২ গুণ বেড়েছে বলে কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে। এই চিত্র সত্যিই উদ্বেগজনক।

ভাবুন তো, একটি সাধারণ মশার কামড় আমাদের কতটা বিরক্ত করতে পারে! আর যখন সেই মশার কামড় ডেঙ্গুর মতো মারাত্মক রোগের কারণ হয়, তখন আতঙ্কিত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। ডেঙ্গু এখন কেবল বর্ষাকালের রোগ নয়, মৌসুম শুরুর আগেই এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে এবং তা বাড়ছেই।

ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান আতঙ্ক: পরিসংখ্যান যা বলছে

মশার উপদ্রবের পাশাপাশি ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ জনজীবনে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে গত শুক্রবার (৩ মে) পর্যন্ত সারাদেশে ২ হাজার ৬১১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ২০ জন। ডেঙ্গু আতঙ্ক তুঙ্গে

ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ডেঙ্গুর সংক্রমণ মৌসুমের আগেই বাড়ছে। মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিলে আক্রান্ত ও মৃত্যু দ্বিগুণ হয়েছে। মার্চে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৩৩৬ জন, আর এপ্রিলে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭০১। মার্চে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিলেন তিনজন, আর এপ্রিলে মারা গেছেন সাতজন। গত বছর একই সময়ে (এপ্রিল) রোগী ছিল ৫০৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল দুজনের। এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, ডেঙ্গুর পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় এবার দ্রুত খারাপ হচ্ছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ডেঙ্গু এখন শুধু রাজধানীর সমস্যা নয়। মোট আক্রান্ত রোগীর ৫৬.৯৮% ঢাকার বাইরের। এটি दर्शाता যে, ডেঙ্গুর প্রকোপ সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে এবং এটি একটি জাতীয় জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা: কতটা কার্যকর?

পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিটি কর্পোরেশনগুলো যে একেবারে নিষ্ক্রিয়, তা নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) মশক নিধনে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করছে। যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি, খিলগাঁও সহ বিভিন্ন এলাকায় এসব অভিযান চালানো হয়েছে, যেখানে শত শত পরিচ্ছন্নতাকর্মী অংশ নিচ্ছেন। ডিএসসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ডেঙ্গু প্রতিরোধে দুটি স্তরে কাজ শুরু করেছেন:

১. নিয়মিত মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম।

২. বিশেষ মশক নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম এবং জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি (যেমন র?্যালি)।

ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া গুরুত্ব দিয়েছেন নগরবাসী ও সিটি কর্পোরেশনের সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর। তিনি নাগরিকদের সচেতন হওয়ার এবং বাসাবাড়ির ভেতরে ও আশেপাশে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে এবং আমাদের ঘর বা আশপাশের ছোট ছোট পাত্রে জমা পানিই তাদের বংশবৃদ্ধির প্রধান উৎস।

এই উদ্যোগগুলো প্রশংসার যোগ্য। তবে প্রশ্ন হলো, মশার সংখ্যা যদি ১২ গুণ বাড়ে এবং ডেঙ্গু যদি সারা দেশে ছড়াতে শুরু করে, তাহলে এই উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট? মশক নিধনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ব্যবহৃত ওষুধ মশা মারতে কতটা সক্ষম, বা মশা কি সেই ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে – এসব বিষয়ও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

মশার বিস্তার: পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের ভূমিকা

জনস্বাস্থ্যবিদরা মশার এই অস্বাভাবিক বিস্তারের পেছনে কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো থেমে থেমে বৃষ্টি। হঠাৎ বৃষ্টি হলে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে, যা এডিস মশার ডিম পাড়ার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। কিন্তু বৃষ্টি থেমে গেলে সেই জমে থাকা পানি থেকে মশার লার্ভা দ্রুত পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়।

এখানেই চলে আসে পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গ। যদিও সরাসরি এই পোস্টে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি যে বর্তমান মশার প্রকোপ জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ফল, তবে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তন এবং অসময়ের প্রাকৃতিক ঘটনা (যেমন হঠাৎ ভারী বৃষ্টি) মশাবাহিত রোগের বিস্তারকে প্রভাবিত করতে পারে।

  1. তাপমাত্রা বৃদ্ধি: মশার ডিম ফোটার এবং পূর্ণাঙ্গ মশা হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োজন। উষ্ণতা বাড়লে মশার জীবনচক্র দ্রুত সম্পন্ন হয়, ফলে তাদের বংশবৃদ্ধি দ্রুত হয়।
  2. বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তন: অনিয়মিত এবং থেমে থেমে বৃষ্টিপাত এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। শহরাঞ্চলে অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা বা গৃহস্থালীর অব্যবহৃত পাত্রে পানি জমে থাকা এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
  3. অপরিকল্পিত নগরায়ন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: ঢাকা সহ অনেক শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে। ড্রেন, নালা, আবর্জনার স্তূপ – এগুলো মশা উৎপাদনের উর্বর ভূমি।

এই প্রেক্ষাপটে, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ জনজীবন এবং ডেঙ্গুর প্রকোপকে কেবল একটি সাধারণ সমস্যা হিসেবে দেখলে চলবে না। এটি আমাদের পরিবেশের নাজুক অবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাবের একটি সতর্কবার্তা হতে পারে। আমাদের চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা, পানি জমে থাকা স্থানগুলো দ্রুত পরিষ্কার করা এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এখন কেবল পরিচ্ছন্নতার অংশ নয়, এটি আমাদের জীবন রক্ষারও অংশ।

আমাদের করণীয়: সচেতনতা এবং পদক্ষেপ

সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলো তাদের কাজ করছে বা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেবল তাদের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। মশা নিধনে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব আছে। বিশেষ করে এডিস মশা যেহেতু প্রধানত দিনের বেলায় কামড়ায় এবং পরিষ্কার পানিতে জন্মায়, তাই আমাদের নিজেদের বাড়ি এবং তার আশেপাশে সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি।

  1. জমতে থাকা পানি সরান: ফুলের টব, টায়ার, বালতি, অব্যবহৃত পাত্র, এমনকি এসির নিচে জমে থাকা পানি – এই সব জায়গায় এডিস মশা ডিম পাড়তে পারে। নিয়মিত এগুলো পরিষ্কার করুন।
  2. মশারি ব্যবহার করুন: দিনের বেলাতেও মশারি ব্যবহার করা নিরাপদ।
  3. পুরোনো জিনিসপত্র পরিষ্কার করুন: ছাদের ওপর বা বারান্দায় রাখা পুরোনো জিনিসপত্রে পানি জমতে পারে। এগুলো সরিয়ে ফেলুন বা এমনভাবে রাখুন যেন পানি না জমে।
  4. সচেতনতা বৃদ্ধি: আপনার প্রতিবেশী, বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ডেঙ্গু এবং মশা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন।
  5. কর্তৃপক্ষকে জানান: আপনার এলাকায় যদি মশার উপদ্রব খুব বেশি হয় বা কোথাও প্রচুর পরিমাণে পানি জমে থাকে, যা আপনার পক্ষে পরিষ্কার করা সম্ভব নয়, তাহলে সিটি কর্পোরেশনকে জানান।

মশার এই সমস্যা এবং ডেঙ্গুর প্রকোপ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন নই। পরিবেশের ছোট ছোট পরিবর্তনও আমাদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মোকাবিলায় বড় পরিসরে নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু ছোট পরিবর্তন এনেও আমরা পরিবেশের সুরক্ষায় অবদান রাখতে পারি এবং নিজেদের নিরাপদ রাখতে পারি। মশার উপদ্রব হয়তো সেই পরিবর্তনের তাগিদই দিচ্ছে আমাদের।

শেষ কথা: সুরক্ষার পথে আমরা একসাথে

মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হওয়াটা কষ্টের, ডেঙ্গুর আতঙ্ক আরও বেশি কষ্টের। কিন্তু এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ আমাদের নিজেদেরই তৈরি করতে হবে। সরকার, সিটি কর্পোরেশন এবং জনগনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে। আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সচেতন হওয়া এবং নিজেদের চারপাশ পরিষ্কার রাখা – এই সব কিছুই একে অপরের সঙ্গে জড়িত।

এই সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সক্রিয় হতে হবে। নিজেদের এবং পরিবারের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার ছোট্ট একটি পদক্ষেপও হয়তো অনেক জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে আপনার যা যা প্রয়োজন (যেমন মশারি, স্প্রে, বা সচেতনতামূলক সামগ্রী), সেগুলো সংগ্রহ করুন এবং সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করুন। আপনার সচেতনতাই এই যুদ্ধে আপনার এবং আপনার প্রিয়জনদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

এই বিষয়ে আরও জানতে এবং পরিবেশ রক্ষায় আপনার করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় অংশ নিতে আমাদের সাথেই থাকুন। আপনার মতামত নিচে কমেন্ট করে জানান এবং এই পোস্টটি শেয়ার করে অন্যদেরও সচেতন করুন। আপনার সহযোগিতা এই জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ