সীমান্তের ওপারে ভারতে গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে সিলেটের নদ-নদীতে পানি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি সিলেটেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। যদিও এখনও কোনো নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেনি, তবুও সিলেটে নদ-নদীর পানি বাড়ছে, তলিয়ে গেছে গোয়াইনঘাট-রাধানগর সড়ক—এই সংবাদ স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি আবারও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাবের বিষয়টি সামনে এনেছে। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় আতঙ্কে এলাকাবাসী
উজানের ঢল, ভাটির শঙ্কা: সিলেটের নদ-নদীর বর্তমান চিত্র
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, জেলার প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। সারি-গোয়াইন ও ধলাই নদের পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে আজ সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৪১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ বৃষ্টিপাতই সিলেটের জন্য মূল সতর্কবার্তা। ভারতে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢল সীমান্তের নদ-নদী দিয়ে সিলেটে নেমে আসে, যা নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলার নিম্নাঞ্চলে দ্রুত পানি বাড়ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। গোয়াইনঘাট উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র জাফলং ও বিছনাকান্দি এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব স্থানে পর্যটকদের ভ্রমণ করতে না যাওয়াটাই ভালো বলে স্থানীয় লোকজন পরামর্শ দিয়েছেন। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় আতঙ্কে এলাকাবাসী
গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উপজেলার গোয়াইনঘাট-রাধানগর সড়কের নিচু অংশের অংশবিশেষ প্লাবিত হয়েছে। তবে বৃষ্টি কমে এলেই পানি নেমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখনও উপজেলার কোনো এলাকা প্লাবিত না হলেও পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় কিছু কিছু এলাকায় পানি বাড়ছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনও কারো পানিবন্দী অবস্থায় থাকার খবর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছে এবং জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনা খাবারের মজুত রাখা হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গতকালের চেয়ে আজ পানি কিছুটা কমেছে। নিম্নাঞ্চলে পানি থাকলেও কোনো গ্রাম বা এলাকা প্লাবিত হয়নি। উপজেলায় ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে এখনও কারো আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।
সিলেট নগরের জলাবদ্ধতা: এক ভিন্ন সংকট
শুধু নদ-নদীর জলস্ফীতি নয়, সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিক অতিবৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সিটি করপোরেশন দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জরুরি যোগাযোগের জন্য কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ওয়ার্ড সচিবদের নিজেদের অধিক্ষেত্রে অবস্থান করে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শনের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রুততম সময়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৬টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ১৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টি আজও অব্যাহত আছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ভূমিকা
সিলেটে নদ-নদীর জল বৃদ্ধি এবং আকস্মিক জলাবদ্ধতার ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। এগুলো মূলত জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের উপর মানুষের অবিবেচক হস্তক্ষেপের ফল। বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন আসছে। অতিবৃষ্টি, অসময়ের বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সিলেট অঞ্চলের মতো নিম্নাঞ্চলগুলোতে। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় আতঙ্কে এলাকাবাসী
- বন উজাড়: পাহাড় ও টিলা কেটে বন উজাড় করার ফলে ভূমি ক্ষয় বাড়ছে এবং পাহাড়ি ঢল আরও সহজে লোকালয়ে নেমে আসছে।
- নদী দখল ও ভরাট: নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে দখল ও ভরাটের কারণে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পানি উপচে পড়ছে।
- অপরিকল্পিত নগরায়ণ: সিলেট নগরে অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতা জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ।
এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন কোনও দূর ভবিষ্যতের বিষয় নয়, এটি আমাদের বর্তমান বাস্তবতা। পরিবেশের প্রতি আমাদের সচেতনতা এবং সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
সতর্কতা ও প্রস্তুতি: দুর্যোগ মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা
যদিও এখনও বিপদসীমা অতিক্রম করেনি, তবুও সিলেটে নদ-নদীর পানি বাড়ছে, তলিয়ে গেছে গোয়াইনঘাট-রাধানগর সড়ক – এই পরিস্থিতিকে অবহেলা করা ঠিক হবে না। স্থানীয় প্রশাসন এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব।
- করণীয়:আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং নদীর জলস্তরের খবর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।
- নিচু এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক থাকা এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে নেওয়া।
- শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানীয় জল ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র মজুত রাখা।
- প্রয়োজনে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা।
- কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে চলা এবং গুজব থেকে বিরত থাকা।
শেষ কথা:
সিলেটের বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে এবং এর ফলস্বরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
আপনার এলাকায় কি এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোনো পূর্বাভাস রয়েছে? সিলেটে নদ-নদীর পানি বাড়ছে, তলিয়ে গেছে গোয়াইনঘাট-রাধানগর সড়ক – এই খবরের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার মতামত কী? দুর্যোগ মোকাবিলায় আপনার কোনো বিশেষ প্রস্তুতি বা পরামর্শ থাকলে কমেন্ট করে আমাদের জানান। আসুন, সকলে মিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার অঙ্গীকার করি।