টাঙ্গুয়ার হাওর – নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশি, সারি সারি হিজল-করচ গাছ আর ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা পাখির দল। সুনামগঞ্জের এই হাওর শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্ব ঐতিহ্যেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু সম্প্রতি এই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এক নীরব সংকটের মুখোমুখি। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন এবং আমাদের অসচেতনতা ধীরে ধীরে কেড়ে নিচ্ছে হাওরের প্রাণ। টাঙ্গুয়ার হাওর
এই সংকট মোকাবেলায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষা করতে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন জারি করেছে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। চলুন, এই নির্দেশনার আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করি এবং বুঝি, একজন সচেতন পর্যটক হিসেবে আমাদের করণীয় কী।
কেন এই নির্দেশনা এলো? সংকটের গভীরে
ধরা যাক, দিনটি ছিল শনিবার। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন পর্যটকদের জন্য এই নির্দেশনাগুলো জারি করে। কিন্তু কেন হঠাৎ এই পদক্ষেপ? উত্তরটা লুকিয়ে আছে হাওরপাড়ের মানুষের হাহাকার আর পরিবেশবাদীদের উদ্বেগের মাঝে। টাঙ্গুয়ার হাওর
টাঙ্গুয়ার হাওর কেবল একটি জলাভূমি নয়, এটি একটি জটিল বাস্তুতন্ত্র। ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত এই হাওরে আছে ১০৯টি বিল, অসংখ্য খাল-নালা আর মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা ৩৮টি ঝর্ণার মিঠা পানি। এই হাওর হাজারো প্রজাতির মাছ, পাখি আর জলজ উদ্ভিদের অভয়ারণ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটনের নামে যা হচ্ছে, তাকে ‘উৎপাত’ বললেও কম বলা হয়।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার
আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এলাকাবাসী তাদের ক্ষোভ ও অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। তারা জানান, পর্যটকদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক বর্জ্যে হাওরের পানি দূষিত হচ্ছে, উচ্চস্বরে গান-বাজনায় পাখিরা বিরক্ত হয়ে এলাকা ছাড়ছে, আর ইঞ্জিনচালিত নৌকার অবাধ বিচরণ নষ্ট করছে মাছের আবাসস্থল। পর্যটনের কারণে স্থানীয়রা আর্থিকভাবে লাভবান তো হচ্ছেনই না, উল্টো তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। হাওরের সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, কিন্তু সুরক্ষার কোনো উদ্যোগ নেই। এই সম্মিলিত উদ্বেগের প্রতি সাড়া দিয়েই প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওর
জেলা প্রশাসনের ১২টি জরুরি নির্দেশনা: যা আপনাকে মানতেই হবে
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি এবং সৌন্দর্য অটুট রাখতে আমাদের প্রত্যেককে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। জেলা প্রশাসনের দেওয়া ১২টি নির্দেশনা হলো সেই নিয়মাবলীর ভিত্তি। আসুন, সহজভাবে জেনে নিই কী কী সেই নির্দেশনা:
১. নির্দিষ্ট নৌপথ ব্যবহার: হাওরের যেখানে-সেখানে নৌকা চালানো যাবে না। প্রশাসন নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার করতে হবে। এতে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল সুরক্ষিত থাকবে।
২. লাইফজ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক: আপনার নিরাপত্তার জন্যই এই নিয়ম। হাওরের আবহাওয়া কখন কেমন থাকে, তা বলা মুশকিল। তাই বাড়তি সতর্কতা জরুরি।
৩. স্থানীয়দের থেকে সেবা নিন: ভ্রমণের জন্য স্থানীয় গাইড ও সার্ভিস প্রোভাইডারদের সাহায্য নিন। এতে তারা যেমন আর্থিকভাবে উপকৃত হবে, তেমনি আপনিও হাওর সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাবেন।
৪. প্লাস্টিককে ‘না’ বলুন: হাওরে প্লাস্টিকের বোতল, প্যাকেট বা যেকোনো প্লাস্টিক পণ্য নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। প্রকৃতিতে মিশে যেতে শত শত বছর সময় নেওয়া এই প্লাস্টিক জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ।
৫. দূর থেকে দেখুন প্রকৃতির রূপ: পাখি বা অন্যান্য প্রাণী দেখার জন্য খুব কাছে যাওয়ার দরকার নেই। দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে তাদের সৌন্দর্য উপভোগ করুন। এতে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটবে না।
৬. আগুন জ্বালানো নিষেধ: হাওরের মধ্যে ক্যাম্পফায়ার বা যেকোনো ধরনের আগুন জ্বালানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
৭. শব্দ দূষণ বন্ধ করুন: উচ্চস্বরে গান-বাজনা বা মাইক বাজানো থেকে বিরত থাকুন। আপনার আনন্দ যেন অন্য প্রাণী বা মানুষের বিরক্তির কারণ না হয়।
৮. পানিতে বর্জ্য ফেলবেন না: চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, কিংবা যেকোনো অজৈব বর্জ্য হাওরের পানিতে ফেলা যাবে না। মনুষ্যসৃষ্ট সকল বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন বা নিজের সাথে ফিরিয়ে আনুন।
৯. প্রকৃতি থেকে কিছু নেবেন না: হাওর থেকে মাছ ধরা, পাখি শিকার করা, পাখির ডিম সংগ্রহ করা বা বনজ সম্পদ নষ্ট করা দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রকৃতিকে তার মতো থাকতে দিন।
১০. রাসায়নিক ব্যবহার নিষিদ্ধ: হাওরের পানিতে ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু বা অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করবেন না। এই রাসায়নিকগুলো পানির গুণমান নষ্ট করে এবং জলজ প্রাণীদের জন্য বিষাক্ত।
১১. গাছ কাটা বা ডাল ভাঙা চলবে না: হাওরের সৌন্দর্যবর্ধনকারী হিজল-করচ বা অন্য কোনো গাছের ডাল ভাঙা বা কাটা থেকে বিরত থাকুন।
১২. সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ নিষেধ: হাওরের ‘কোর জোন’ বা সংরক্ষিত মূল অংশে প্রবেশ করা যাবে না। এই এলাকাগুলো হাওরের বাস্তুতন্ত্রের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জনাব মো. ইলিয়াস মিয়া যথার্থই বলেছেন, “টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের সম্পদ। তাই হাওরে এমন কোনো কিছু করা যাবে না যাতে প্রকৃতি, পরিবেশ ও হাওরের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। এটি আমরা হতে দেব না। এ জন্য সবার সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।”
পর্যটন, পরিবেশ এবং আমাদের দায়বদ্ধতা
এই নির্দেশনাগুলো কেবল কিছু নিয়মকানুন নয়, এগুলো হাওরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকটময় সময়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো ‘রামসার সাইট’ রক্ষা করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। আমাদের বুঝতে হবে, দায়িত্বশীল পর্যটনই পারে হাওরের সৌন্দর্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে।
যখন আমরা প্লাস্টিক বর্জন করি
তখন আমরা শুধু হাওরকেই রক্ষা করি না, বরং বৈশ্বিক প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হই। যখন আমরা শব্দ দূষণ করি না, তখন আমরা প্রকৃতির নীরবতাকে সম্মান জানাই। যখন আমরা স্থানীয়দের থেকে সেবা নিই, তখন আমরা টেকসই পর্যটনকে উৎসাহিত করি।
এলাকাবাসীর দাবি, মূল হাওরে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বন্ধ করে হাতে চালানো নৌকার ব্যবস্থা করা হোক। এটি একটি চমৎকার প্রস্তাব। এতে দূষণ যেমন কমবে, তেমনি স্থানীয় মাঝি সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থানও বাড়বে।
শেষ কথা
টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের পরিকল্পনা করার আগে এই ১২টি নির্দেশনা ভালোভাবে জেনে নিন এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার প্রতিজ্ঞা করুন। আপনার একটি ছোট সচেতন পদক্ষেপই পারে এই অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে।
আসুন, আমরা শুধু পর্যটক না হয়ে পরিবেশের বন্ধু হই। টাঙ্গুয়ার হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি এর সুরক্ষায়ও ভূমিকা রাখি। এই পোস্টটি শেয়ার করে অন্যদেরও সচেতন করুন এবং কমেন্টে জানান, টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন। আপনার মতামত মূল্যবান।