27 C
Bangladesh
বুধবার, জুন ২৫, ২০২৫
spot_img

শুধু একটি মন্ত্রণালয় নয়: নদী রক্ষায় কেন সবার উদ্যোগ জরুরি?

নদীর দখল-দূষণ বন্ধে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টা অতীতের তুলনায় কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এখনো অধরা। এটি স্পষ্ট যে শুধুমাত্র একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আমাদের নদীগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। নদী রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি সমন্বিত এবং বহু-মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উদ্যোগ অপরিহার্য। শুধু একটি মন্ত্রণালয় নয়

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ‘নদী, হাওর, বন, কৃষিজমি ও পাহাড়: পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা তুলে ধরেন।

পরিবেশ ও উন্নয়নের নতুন সংজ্ঞা

আলোচনায় অংশ নিয়ে লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ জোর দিয়ে বলেন, পরিবেশ এবং উন্নয়নকে প্রায়শই একটি দ্বিকেন্দ্রিক বিন্যাসের (বাইনারি) মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, যেখানে একটিকে অন্যটির প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা হয়। অথচ সত্যিকারের উন্নয়ন সেটিই যা প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুরক্ষা দেয়, তাকে অবজ্ঞা করে নয়। তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের অংশ, যা আমাদের জীববৈচিত্র্যের অসীম গুরুত্ব প্রমাণ করে। এই প্রেক্ষাপটে, সকল বনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাণিজ্যিক স্থাপনা নিষিদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি তুলে ধরেন। শুধু একটি মন্ত্রণালয় নয়

পাভেল পার্থ আরও বলেন, আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি একক মন্ত্রণালয় দিয়ে এই বিশাল কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এর জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় বন অধিকার আইন প্রণয়ন এবং বন ও পাহাড় রক্ষায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকায়ত জ্ঞানকে রাষ্ট্রীয় পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির অংশ করার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।

আইনের প্রয়োগ ও উদ্বেগের চিত্র

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম জানান, নদীসহ সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। তিনি বলেন, আইন মানার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭তম, যা উদ্বেগজনক। অন্যদিকে, পরিবেশ রক্ষার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৯তম, যা আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও, দখল-দূষণের যে ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখছি, তাতে ভবিষ্যতে এই সূচকে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকবে না বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। শুধু একটি মন্ত্রণালয় নয়

তাসলিমা ইসলাম আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে নদীর প্রধান সমস্যাগুলো হলো দখল, দূষণ, এবং অবৈধ বালু ও পাথর উত্তোলন। দেশের কোনো আইনেই নদীকে সুনির্দিষ্টভাবে “নদী” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি; বরং কোনো কোনো আইনে নদীকে জলাশয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। তিনি মনে করিয়ে দেন যে, দেশে ১৫টি আইন এবং আদালতের নির্দেশনা রয়েছে যা নদীকেন্দ্রিক। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এসব আইন ও আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন হবে।

প্লাস্টিক দূষণ ও আঞ্চলিক সংলাপের প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সুফিয়া খানম জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে যে ১০টি নদী ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণের শিকার, তার মধ্যে ৮টিই এশিয়ায় অবস্থিত। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নদীতে ওই প্লাস্টিক দূষণ এসে জমা হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে তিনি আঞ্চলিক সংলাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তুলে ধরার আহ্বান জানান।

এছাড়াও, সুফিয়া খানম সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘ফ্লাই অ্যাশবাহী’ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি জানান, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ২২ কোটি ৪৪ লাখ টন ‘ফ্লাই অ্যাশ’ ভারত থেকে এসেছে এবং এগুলো পরিবহন করতে গিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষায় এসব জাহাজ চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের জোর দাবি জানান।

অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও ঐক্যের আহ্বান

বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির সভা পরিচালনা করেন এবং বলেন যে, অপরিকল্পিত উন্নয়নে কেবল প্রকৃতিরই অপরিসীম ক্ষতি হচ্ছে না, এর সঙ্গে মানুষ ও তাদের জীবন-জীবিকাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। তিনি বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

সভায় সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকার নদ-নদী, বন, হাওর-জলাশয়ের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা সভার সভাপতিত্ব করেন।

শেষ কথা

নদী রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় শুধুমাত্র কথার ফুলঝুরি বা বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সকল মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট সংস্থা, এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এই আলোচনার মাধ্যমে আপনারা কি আমাদের নদী ও পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী? অথবা এই বিষয়ে আপনার কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা মতামত থাকলে নিচে মন্তব্য করে জানান!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ