27.4 C
Bangladesh
শনিবার, জুন ২৮, ২০২৫
spot_img

শহরের বস্তিতে কেন বাড়ছে মানুষ? বাস্তুচ্যুত হবে ২.৬ কোটি বাংলাদেশি!

ঢাকা, ২৬ জুন ২০২৫: একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, আপনার ঘর, আপনার চেনা গ্রাম বা শহর, আপনার শৈশবের খেলার মাঠ—সবকিছু ছেড়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াতে হচ্ছে। এই ভয়ংকর বাস্তবতা কোনো সিনেমার গল্প নয়, বরং বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের এক আসন্ন চিত্র। উন্নয়ন সংস্থা ‘কারিতাস বাংলাদেশ’-এর এক আশঙ্কানুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন-এর বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে। বাস্তুচ্যুত হবে ২.৬ কোটি বাংলাদেশি

এই বিশাল সংখ্যাটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হারানো স্বপ্ন আর বেঁচে থাকার সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল। সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক পরামর্শ সভায় এই উদ্বেগজনক তথ্যটি সামনে আনা হয়, যা আমাদের পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

কেন এই শঙ্কা? পরিসংখ্যান কী বলছে?

বিষয়টি হঠাৎ করে সামনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা পরিবেশ অবক্ষয় এবং এর ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের এক লম্বা ইতিহাস। সভায় জিআইজেড-এর ২০২৩ সালের একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়, যা থেকে জানা যায়:

  1. বিগত দিনের চিত্র: ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল—এই ছয় বছরেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের প্রায় ৪৭ লাখের বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন।
  2. উপকূলের হাহাকার: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শহরে আশ্রয় নেওয়া অভিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৫৭ শতাংশই আসছে শুধুমাত্র উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা থেকে।

এই পরিসংখ্যানগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সংকট কতটা গভীর। নদী ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক জোয়ার এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগগুলো উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। টিকে থাকার আর কোনো উপায় না পেয়েই তারা নিজের জন্মভিটা ছেড়ে শহরের বস্তিতে এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে ছুটছেন। বাস্তুচ্যুত হবে ২.৬ কোটি বাংলাদেশি

উপকূলের কান্না: মাঠের বাস্তবতা

এই সংকট শুধু কাগজে-কলমের পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ নেই। এর এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। তিনি বলেন, “উপকূলীয় এলাকায় হাজার হাজার একর ফসলি জমি চিংড়ি চাষের জন্য ‘ঘের’ করা হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য টেকসই বাঁধ নেই। দুর্যোগের সময় উপকূলের মানুষ নিজেরাই মানবঢাল তৈরি করে বাঁধ রক্ষা করেন। তারা মন্ত্রণালয় কিংবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপেক্ষায় থাকেন না।”

তাঁর এই কথাগুলো থেকে বোঝা যায়, উপকূলের মানুষ প্রকৃতির সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত। যখন সেই যুদ্ধে টিকে থাকতে পারেন না, তখনই তারা বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হন। এটি কোনো স্বেচ্ছায় অভিবাসন নয়, বরং এক প্রকার বাধ্যগত নির্বাসন।

শহরের চাপ: এক নতুন সংকট

উপকূল থেকে আসা এই বিশাল জনগোষ্ঠী কোথায় যাচ্ছে? উত্তরটি আমাদের সবারই জানা—দেশের বড় বড় শহরগুলোতে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল বলেন, “তারা নিজ এলাকা ছেড়ে শহরের বস্তিতে নিম্নমুখী জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের জীবন-যাত্রার মান কমে যাচ্ছে।”

এর ফলে একদিকে যেমন উপকূলীয় অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ছে, তেমনি শহরের উপরও পড়ছে প্রচণ্ড চাপ। আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সকল নাগরিক পরিষেবার উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যা নগর জীবনেও এক নতুন সংকট তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রভাব যে কতটা সুদূরপ্রসারী, এটি তার একটি অন্যতম উদাহরণ।

সংগ্রাম এবং সমাধান: আশার আলো

তবে এই হতাশাজনক চিত্রের মাঝেও আশার আলো দেখাচ্ছে কারিতাস বাংলাদেশের মতো কিছু সংস্থা। সভায় জানানো হয়, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে কারিতাস বাংলাদেশ এ পর্যন্ত বহুবিধ উদ্যোগ নিয়েছে।

  1. ১০ লাখের বেশি মানুষের জন্য গৃহ নির্মাণ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়েছে।
  2. ৩ হাজারেরও বেশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং ১৪ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে সক্ষম করে তোলা হয়েছে।
  3. উপকূলীয় ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় ৩২৯টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে, যা বিপদের সময় মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল।

এই প্রচেষ্টাগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু সংকট মোকাবেলায় এটি যথেষ্ট নয়।

শেষ কথা: এখনই সময় পদক্ষেপ নেওয়ার

২০৫০ সালের মধ্যে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার এই শঙ্কা কেবল একটি সতর্কবার্তা নয়, এটি আমাদের জন্য এক চূড়ান্ত বিপদসংকেত। এই সংকট মোকাবেলা করতে হলে শুধুমাত্র প্রকল্পভিত্তিক কাজ করলেই চলবে না, প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন।

উপকূলের মানুষের জীবন-মান ধরে রাখতে এবং তাদের নিজের এলাকায় নিরাপদে রাখতে হলে সমন্বিত ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। मजबूत বাঁধ নির্মাণ, লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন, এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার মতো পদক্ষেপে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনপরিবেশ রক্ষার এই লড়াই কোনো একক ব্যক্তি বা সংস্থার নয়, এই লড়াই আমাদের সকলের।

আপনি কি মনে করেন, এই ভয়াবহ সংকট মোকাবেলায় আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা কোনটি? আপনার এলাকার পরিবেশ রক্ষায় আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী করছেন? নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ