30.9 C
Bangladesh
শুক্রবার, জুলাই ৪, ২০২৫
spot_img

দিনাজপুরে অভিযান: কেন আকাশমণি-ইউক্যালিপটাস ধ্বংস করা হচ্ছে?

ভাবুন তো একবার, সরকারি লোকজন নার্সারিতে অভিযান চালাচ্ছে, কিন্তু কোনো অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে নয়, বরং হাজার হাজার গাছের চারা ধ্বংস করতে! অদ্ভুত শোনাচ্ছে, তাই না? কিন্তু ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে। যেখানে উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মিলে আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসের মতো জনপ্রিয় গাছের চারা ধ্বংসে নেমেছে। আকাশমণি-ইউক্যালিপটাস ধ্বংস

খবরটা শুনে অনেকেই হয়তো ভ্রু কুঁচকে ভাবতে পারেন, গাছ লাগানো যেখানে पुण्य, সেখানে গাছ ধ্বংস করা হচ্ছে কেন? এখানেই লুকিয়ে আছে এক গভীর বাস্তবতা। এই অভিযান কোনো খামখেয়ালিপনা নয়, বরং আমাদের পরিবেশ এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য একটি দেরিতে হলেও অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যে গাছগুলোকে আমরা এতদিন দ্রুত বর্ধনশীল আর লাভের উৎস হিসেবে জেনে এসেছি, সেগুলোই আজ আমাদের মাটির জন্য ‘সবুজ ঘাতক’ হিসেবে প্রমাণিত। চলুন, এই আপাত ধ্বংসযজ্ঞের পেছনের পরিবেশগত কারণগুলো একটু তলিয়ে দেখি। আকাশমণি-ইউক্যালিপটাস ধ্বংস

কেন এই গাছগুলো ‘খলনায়ক’?

আকাশমণি (Acacia auriculiformis) এবং ইউক্যালিপটাস—এই দুটি গাছের নাম আমাদের সবার কাছেই পরিচিত। রাস্তার ধারে, সামাজিক বনায়নে, এমনকি ব্যক্তিগত জমিতেও এদের ব্যাপক উপস্থিতি। দ্রুত বাড়ে, দেখতেও সুন্দর, আর কাঠ হিসেবেও বেশ কাজের—এই ধারণা থেকেই গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে এদের রমরমা চাষাবাদ চলছে। কিন্তু এই আপাত সুবিধার আড়ালে যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি লুকিয়ে ছিল, তা বুঝতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গাছগুলো কয়েকটি কারণে আমাদের দেশীয় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের (ecosystem) জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর:

১. পানির দানব: ইউক্যালিপটাস গাছকে বলা হয় ‘পানির দানব’। এটি তার আশপাশের মাটি থেকে খুব পরিমাণ পানি শোষণ করে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যায়। যে এলাকায় ইউক্যালিপটাসের বাগান করা হয়, সেখানে কিছুদিন পরেই পানির সংকট দেখা দেয়, আশেপাশের নলকূপে পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। খরাপ্রবণ বাংলাদেশে এটি একটি নীরব ঘাতকের মতো কাজ করে।

২. মাটির শত্রু: এই গাছগুলোর পাতা সহজে পচে না এবং মাটিতে হিউমাস তৈরি করে না। উল্টো, এদের পাতা ও শিকড় থেকে ‘অ্যালোপ্যাথিক’ নামক এক ধরনের রাসায়নিক নির্গত হয়, যা অন্য কোনো দেশীয় প্রজাতির গাছ বা ফসল জন্মাতে বাধা দেয়। অর্থাৎ, যেখানে এই গাছগুলো থাকে, সেখানে ধীরে ধীরে অন্য সব উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে একটি নিষ্প্রাণ ‘মনোকালচার’ বা একক প্রজাতির বন তৈরি হয়। এতে মাটির উর্বরতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।

৩. জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি: আমাদের দেশীয় গাছপালা যেমন—আম, জাম, কাঁঠাল, বট, পাকুড়—এগুলো পাখিদের আশ্রয় দেয়, মৌমাছি ও প্রজাপতির খাবার জোগায়। কিন্তু আকাশমণি বা ইউক্যালিপটাস গাছে পাখিরা বাসা বাঁধে না, মৌমাছিরাও মধু সংগ্রহ করতে পারে না। ফলে এই গাছগুলো যে এলাকায় বিস্তার লাভ করে, সেখান থেকে ধীরে ধীরে পশুপাখি ও উপকারী কীটপতঙ্গ হারিয়ে যায়, যা আমাদের জীববৈচিত্র্যের জন্য এক অশনি সংকেত।

সরকারের ঘুম ভাঙল অবশেষে

এই ক্ষতিকর প্রভাবগুলো অনুধাবন করেই সরকার অবশেষে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। চলতি বছরের ১৫ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় একটি যুগান্তকারী প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির মতো আগ্রাসী প্রজাতির গাছের চারা উৎপাদন, রোপণ ও বিক্রি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়। আকাশমণি-ইউক্যালিপটাস ধ্বংস

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে যে অভিযানটি পরিচালিত হয়েছে, তা মূলত এই জাতীয় নীতিরই বাস্তবায়ন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল হুদার নেতৃত্বে এই অভিযানে শুধু চারা ধ্বংসই করা হয়নি, নার্সারির মালিকদেরও সতর্ক করা হয়েছে।

তবে সরকার শুধু ‘লাঠি’ নয়, ‘গাজর’ নীতিও গ্রহণ করেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নয়ন কুমার সাহা জানান, যেসব নিবন্ধিত নার্সারি স্বেচ্ছায় এসব ক্ষতিকর চারা ধ্বংস করবে, তাদের প্রতি চারার জন্য ৪ টাকা করে প্রণোদনা দেওয়া হবে। এটি নার্সারি মালিকদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে এবং দেশীয় প্রজাতির গাছের চারা উৎপাদনে উৎসাহিত করতে একটি চমৎকার উদ্যোগ। অন্যদিকে, যারা আইন অমান্য করে গোপনে এসব গাছের চারা বিক্রি করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।

পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গি: এটি শুধু গাছ বদলানো নয়, চিন্তার বদল

এই অভিযানকে শুধু কয়েকটি গাছের চারা ধ্বংসের ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি আসলে আমাদের বন ও বনায়ন নিয়ে গত কয়েক দশকের ভুল নীতির সংশোধনের একটি প্রচেষ্টা। একটা সময় ছিল যখন ‘সামাজিক বনায়ন’-এর নামে দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশি গাছ লাগিয়ে বনভূমি বাড়ানোর দিকেই মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক লাভকেই তখন প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন-এর এই সংকটকালে আমরা বুঝতে পারছি যে, বনায়নের উদ্দেশ্য শুধু কাঠ উৎপাদন বা খালি জমি ভরাট করা নয়। একটি সুস্থ বনের কাজ হলো—কার্বন শোষণ করা, মাটির ক্ষয় রোধ করা, পানির স্তর ঠিক রাখা এবং জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করা। আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসের মতো গাছের মনোকালচার বাগান এই উদ্দেশ্যগুলো পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

তাই এই আগ্রাসী প্রজাতিগুলো সরিয়ে দেশীয় ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ (যেমন: আম, জাম, কাঁঠাল, নিম, অর্জুন, হরতকি, বহেরা) লাগানোর যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তা আমাদের পরিবেশ-কে দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ রাখার একমাত্র উপায়। এই দেশীয় গাছগুলো আমাদের মাটির সঙ্গে মানানসই, এরা পানির স্তর ঠিক রাখে, পাখিদের আকর্ষণ করে এবং সামগ্রিকভাবে একটি টেকসই ও স্থিতিশীল বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলে।

শেষ কথা

দিনাজপুরের এই অভিযান একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। এটি সারা দেশের জন্য একটি বার্তা—অর্থনৈতিক লাভের চেয়ে পরিবেশের স্বাস্থ্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো এই পরিবর্তনে কিছুটা সময় লাগবে, নার্সারি মালিকদের সাময়িক ক্ষতি হবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি আমাদের মাটি, পানি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অমূল্য বিনিয়োগ।

আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসের সবুজ কিন্তু নিষ্প্রাণ আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে আমাদের গ্রামগঞ্জে আবার যখন ফিরে আসবে আম-জাম-কাঁঠালের ছায়া, পাখিদের কলকাকলি আর মৌমাছির গুঞ্জন—সেদিনই হবে আমাদের আসল বিজয়। এই ‘সবুজ ঘাতক’দের অপসারণের মধ্য দিয়ে একটি সত্যিকার সবুজ ও টেকসই বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হোক।

আপনার মতামত কী?

আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসের মতো আগ্রাসী প্রজাতির গাছ নির্মূলে সরকারের এই উদ্যোগকে আপনি কীভাবে দেখছেন? আপনার এলাকায় কি এই গাছগুলোর প্রভাব চোখে পড়েছে? পরিবেশ রক্ষায় এমন পদক্ষেপ কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন? আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ