বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের কাছে মাটি মানে শুধু মাটি নয়, এটি এক দীর্ঘশ্বাস। জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে সমুদ্রের নোনা পানি যেভাবে ধীরে ধীরে আবাদি জমিতে হানা দিচ্ছে, তাতে হাজার হাজার হেক্টর জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। যে মাটিতে একসময় সোনার ফসল ফলত, তা আজ লবণাক্ততার অভিশাপে জর্জরিত। কৃষকের স্বপ্নগুলো নোনা পানিতেই বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। নোনা মাটিতে ফলবে সোনা
কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা কখনও থেমে থাকে না। ঠিক এমনই এক প্রেক্ষাপটে আশার আলো নিয়ে এসেছে গাজীপুরের একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁরা এমন এক গমের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা এই নোনা মাটির বিরূপ পরিবেশেই হাসিমুখে বেড়ে উঠতে পারে। এই উদ্ভাবন শুধু একটি নতুন জাতের ফসল নয়, এটি পরিবেশ বিপর্যয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী অস্ত্র। নোনা মাটিতে ফলবে সোনা
ঘটনা সংক্ষেপ: ‘জিএইউ গম ১’ – একটি নামের পেছনের গল্প
গাজীপুরের একটি স্বনামধন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের একদল গবেষক দীর্ঘদিনের সাধনার পর ‘জিএইউ গম ১’ নামের একটি নতুন জাতের গম উদ্ভাবন করেছেন। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি দেশের প্রথম উচ্চ লবণসহিষ্ণু গমের জাত।
- উদ্ভাবনের লক্ষ্য: গবেষকদের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে ফসল ফলানোর সীমাবদ্ধতা দূর করা।
- অনুমোদন: দীর্ঘদিন ধরে কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এর লবণ সহনশীলতা ও উচ্চ ফলন প্রমাণিত হয়। অবশেষে, জাতীয় বীজ বোর্ড গত ১৭ জুন এই জাতটিকে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য ছাড়পত্র দেয়।
- শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য: এটি শুধু লবণ সহনশীলই নয়, এটি উচ্চ ফলনশীল এবং সাধারণ গমের চেয়ে অধিক প্রোটিনসমৃদ্ধ। ডিইউএস (DUS) টেস্টে এর ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত হয়েছে, যা একে অন্য জাত থেকে আলাদা করেছে।
এই উদ্ভাবনটি দেশের মোট উদ্ভাবিত ফসলের জাতের সংখ্যাকে ৯১-তে পৌঁছে দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কৃষিখাতের জন্য একটি মাইলফলক।
বিশ্লেষণ: কেন এই গম শুধু একটি শস্য নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু?
খবরটি শুনে মনে হতে পারে, এটি তো কেবলই একটি নতুন ফসলের জাত। কিন্তু এর পেছনের তাৎপর্য অনেক গভীর, যা সরাসরি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন-এর সাথে জড়িত।
১. জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এক জীবন্ত বর্ম (Climate Adaptation in Action):
জলবায়ু পরিবর্তন-এর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাবগুলোর একটি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। এর ফলে বাংলাদেশের মতো নিচু ব-দ্বীপগুলোর উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে। যে কৃষকরা বংশপরম্পরায় ধান বা অন্যান্য ফসল চাষ করতেন, তারা আজ অসহায়। তাদের জমি আছে, কিন্তু ফসল ফলানোর উপায় নেই। নোনা মাটিতে ফলবে সোনা
‘জিএইউ গম ১’ ঠিক এই জায়গাতেই একটি সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি একটি ক্লাসিক ‘ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন’ বা জলবায়ু অভিযোজনের উদাহরণ। আমরা যখন জলবায়ু পরিবর্তনকে থামাতে পারছি না, তখন এর সাথে খাপ খাইয়ে চলার কৌশল উদ্ভাবন করছি। এই গমটি সেই কৌশলের এক জীবন্ত রূপ। লবণাক্ত জমিতে এই গম চাষের মাধ্যমে আমরা একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকেও কৃষকদের রক্ষা করছি।
২. পরিবেশগত পুনরুদ্ধারের নতুন দিগন্ত:
লবণাক্ততার কারণে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া জমিগুলো ধীরে ধীরে তাদের উর্বরতা হারায় এবং সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যায়। এসব জমিতে যখন আবার ফসল ফলানো সম্ভব হবে, তখন মাটির স্বাস্থ্য ফিরতে শুরু করবে। গাছের শিকড় মাটিকে ধরে রাখবে, যা ভূমি ক্ষয় রোধ করবে। ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটির জৈব উপাদান বাড়াবে। অর্থাৎ, এই গম চাষের মাধ্যমে আমরা কেবল ফসলই ফলাবো না, আমরা আসলে একটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ-কে পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে নিয়ে যাব
৩. একটি পরিপূর্ণ প্যাকেজ: অর্থনীতি, পুষ্টি এবং পশুখাদ্য:
গবেষকরা এই জাতটি উদ্ভাবনের সময় কেবল লবণ সহনশীলতার কথাই ভাবেননি, তারা একটি পরিপূর্ণ সমাধানের কথা ভেবেছেন:
- উচ্চ ফলন: স্বাভাবিক মাটিতে হেক্টরপ্রতি ৪.৫ টন এবং লবণাক্ত মাটিতে ৩.৭৫ টন ফলন কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট।
- অল্প সময়ে চাষ: আমন ধান কাটার পর মাত্র ৯৫-১০০ দিনেই এই গম ঘরে তোলা যায়, যা কৃষকদের বছরে একাধিক ফসল ফলানোর সুযোগ করে দেবে।
- উচ্চ প্রোটিন ও পুষ্টি: এই গমে অধিক প্রোটিন এবং পর্যাপ্ত গ্লুটেনিন থাকায় এটি পুষ্টির একটি দারুণ উৎস। এটি আমাদের জাতীয় পুষ্টির চাহিদা মেটাতেও ভূমিকা রাখবে।
- গবাদি পশুর খাদ্য: এই গমের গাছ তুলনামূলকভাবে বড় ও মোটা হওয়ায় এখান থেকে বেশি পরিমাণে খড় পাওয়া যায়। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে গবাদি পশুর খাদ্যের যে তীব্র সংকট, তা লাঘব করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সুতরাং, এটি এমন একটি উদ্ভাবন যা একই সাথে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, কৃষকের আয় এবং পশুখাদ্যের মতো একাধিক সমস্যার সমাধান দিচ্ছে।
শেষ কথা: বিজ্ঞানের শক্তি যখন মানুষের পাশে
‘জিএইউ গম ১’ এর উদ্ভাবন আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করিয়ে দেয়—আমাদের দেশের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা সঠিক সুযোগ এবং সমর্থন পেলে দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখেন। জলবায়ু পরিবর্তন যখন আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন মাঠের গবেষণালব্ধ এসব উদ্ভাবনই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
এই লবণসহিষ্ণু গম হয়তো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন থামিয়ে দেবে না, কিন্তু এটি বাংলাদেশের উপকূলের লাখ লাখ মানুষকে পরিবর্তিত পৃথিবীর সাথে লড়াই করে টিকে থাকার সাহস জোগাবে। এটি মাটির কান্না থামিয়ে আবারও সোনার ফসল ফলানোর স্বপ্ন দেখাবে। এটি প্রমাণ করে, সঠিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগই হতে পারে আমাদের টেকসই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
আপনার মতামত কী?
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এ ধরনের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? আপনার মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন আর কোন কোন ক্ষেত্রে গবেষণা জরুরি? আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে জানান।
টেকসই কৃষি, জলবায়ু অভিযোজন এবং পরিবেশগত যেকোনো প্রকল্পের জন্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ বা কৌশলগত দিকনির্দেশনার প্রয়োজন হলে, আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আসুন, বিজ্ঞান ও প্রকৃতির সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ি।