আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, ঝমঝম করে নামা বৃষ্টি, আর ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ—বর্ষা নিয়ে বাঙালির রোমান্টিকতার শেষ নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের জন্য বর্ষা এখন আর শুধু রোমান্টিকতার নাম নয়, এটি এখন ভয়, শঙ্কা আর উদ্বেগের প্রতিশব্দ। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বন্দর নগরীতে যে বৃষ্টি হচ্ছে, তা নিছক স্বাভাবিক বর্ষণ নয়। এটি আমাদের পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর এক ভয়াল বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতার ভয়
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে যখন ভারী বৃষ্টির সাথে পাহাড়ধসের সতর্কবার্তা জারি করা হয়, তখন বুঝতে হবে পরিস্থিতি সাধারণ নয়। এটি একটি চক্রের অংশ, যার একদিকে রয়েছে প্রকৃতির পরিবর্তনশীল আচরণ, আর অন্যদিকে রয়েছে আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণের নির্মম ক্ষত। পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতার ভয়
বর্তমান চিত্র: শুধু সংখ্যা নয়, সংকটের ইঙ্গিত
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, আবহাওয়া অফিস কী বলছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গায় ৩৩ মিলিমিটার এবং আমবাগানে ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সামনে আরও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতার ভয়
এই সংখ্যাগুলো আপাতদৃষ্টিতে শুধু কিছু পরিমাপ মনে হতে পারে। কিন্তু এর গভীরে লুকিয়ে আছে বড় সংকট ইঙ্গিত। এই “ভারী থেকে অতি ভারী” বৃষ্টির সতর্কবার্তাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, বৃষ্টির চরিত্র বদলে যাচ্ছে। যে বৃষ্টি একসময় ছিল আশীর্বাদ, তা-ই এখন হয়ে উঠছে অভিশাপ। আর এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে জলবায়ু পরিবর্তন।
জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে বৃষ্টির চরিত্র বদলে দিচ্ছে?
মৌসুমি বায়ু প্রতি বছরই আসে। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বায়ুমণ্ডল এখন আগের চেয়ে বেশি জলীয় বাষ্প ধারণ করতে পারে। এর ফলে যখন বৃষ্টি হয়, তখন তা অল্প সময়ে অনেক বেশি তীব্রভাবে ঝরে পড়ে। আগে হয়তো যে পরিমাণ বৃষ্টি ৭২ ঘণ্টায় হতো, এখন তা ২৪ ঘণ্টায় বা তারও কম সময়ে হয়ে যাচ্ছে।
এই তীব্র এবং ঘনীভূত বৃষ্টিপাত দুটি ভয়াবহ সমস্যার জন্ম দেয়, যা চট্টগ্রামের মানুষের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো:
১. জলাবদ্ধতা (Waterlogging): চট্টগ্রামের নগর পরিকল্পনা এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল পুরোনো দিনের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু যখন অল্প সময়ে অস্বাভাবিক পরিমাণ পানি শহরের উপর আছড়ে পড়ে, তখন সেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা তা সামলাতে পারে না। এর সাথে যোগ হয়েছে আমাদের নিজেদের তৈরি করা সংকট—খাল দখল করে ভবন নির্মাণ, পাহাড় কেটে নালা ভরাট করা, এবং প্লাস্টিক বর্জ্যে ড্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়া। ফলে, সামান্য বৃষ্টিতেই বন্দর নগরীর রাস্তাঘাট নদীতে পরিণত হয়। এটি শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই বিপর্যস্ত করে না, এটি অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্যের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
২. পাহাড়ধস (Landslide): চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি শহর। এই পাহাড়গুলোই তার প্রাকৃতিক বর্ম। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নির্বিচারে পাহাড় কেটে আবাসন তৈরি করার ফলে এই পাহাড়গুলো এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গাছপালা কেটে ফেলায় পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে গেছে। যখন তীব্র বৃষ্টি হয়, তখন সেই আলগা মাটি বিপুল পরিমাণ পানি শোষণ করে ভারী হয়ে ওঠে এবং একসময় ধসে পড়ে। প্রতিটি বর্ষায় পাহাড়ধসে হতাহতের খবর এখন যেন একটি রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি প্রকৃতির রোষ নয়, এটি আমাদের লোভ এবং অপরিকল্পনার অনিবার্য পরিণতি।
প্রকৃতির রোষ নাকি আমাদেরই ভুলের মাসুল?
মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তাকে আমরা প্রাকৃতিক ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে পারি। কিন্তু এর ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়কে কোনোভাবেই শুধু ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ বলা চলে না। এটি একটি মানবসৃষ্ট সংকট, যাকে প্রকৃতি আরও ভয়ংকর করে তুলছে।
- অপরিকল্পিত নগরায়ন: আমরা শহরের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত পাহাড় ও জলাশয়গুলোকে ধ্বংস করেছি। উন্নয়নের নামে সবুজকে কংক্রিট দিয়ে ঢেকে দিয়েছি।
- পরিবেশগত আইনের প্রতি উদাসীনতা: পাহাড় কাটা বা খাল দখল যে বেআইনি, তা সবাই জানে। কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ কতটা হয়? এই উদাসীনতাই আজ আমাদের বিপদকে আরও গভীর করেছে।
- সমন্বয়হীনতা: সিটি করপোরেশন, সিডিএ, এবং অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
এই বৃষ্টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, পরিবেশ-কে অগ্রাহ্য করে যে উন্নয়ন, তা টেকসই হতে পারে না। আজ যা জলাবদ্ধতা বা পাহাড়ধস, কাল তা আরও বড় কোনো বিপর্যয়ের রূপ নিতে পারে।
শেষ কথা: সতর্কবার্তার বাইরেও ভাবতে হবে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কবার্তা আমাদের তাৎক্ষণিক বিপদ থেকে বাঁচানোর একটি প্রচেষ্টা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য আমাদের চিন্তার স্তরে পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তন কোনো কাল্পনিক তত্ত্ব নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক রূঢ় বাস্তবতা।
এখন সময় এসেছে প্রতিক্রিয়াশীল (reactive) অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে সক্রিয় (proactive) হওয়ার। আমাদের নগর পরিকল্পনাকে পরিবেশ-বান্ধব করতে হবে, পাহাড় ও জলাশয় রক্ষায় কঠোর হতে হবে, এবং প্রতিটি নাগরিককে পরিবেশ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
আজকের এই বৃষ্টি শুধু কিছু সময়ের জন্য জনজীবন বিপর্যস্ত করছে না, এটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছে। এই বার্তা যদি আমরা এখনো উপলব্ধি করতে না পারি, তাহলে হয়তো সামনে আরও কঠিন সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আপনার মতামত কী?
চট্টগ্রামের এই জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ধসের সংকট মোকাবেলায় আশু করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন? আপনার ভাবনা আমাদের সাথে শেয়ার করুন।
আপনি যদি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, টেকসই নগর পরিকল্পনা বা পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন, তবে আসুন, একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে আমরা একসাথে কাজ করি। আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।