25.5 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুলাই ৮, ২০২৫
spot_img

মাত্র ১৬,৫০০ টাকায় বিক্রি হলো পরিবেশ!

“রক্ষকই যখন ভক্ষক” – এই প্রবাদটি আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। কিন্তু যখন এই প্রবাদটি আক্ষরিক অর্থে আমাদের সামনে ঘটে, তখন তা শুধু হতাশাই বাড়ায় না, বরং আমাদের সিস্টেমের গভীরে থাকা ক্ষতকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ঠিক তেমনই এক আয়না, যেখানে বন রক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রহরী নিজেই গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছেন। টাকায় বিক্রি হলো পরিবেশ

এই ঘটনাটি কেবল একজন ব্যক্তির চাকরি হারানোর বা কয়েকটি গাছ কেটে ফেলার গল্প নয়। এটি আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা, দুর্নীতির বিস্তার এবং জলবায়ু সংকটের মুখে আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতার এক тревоজনক চিত্র। চলুন, এই ঘটনার গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। টাকায় বিক্রি হলো পরিবেশ

ঘটনার অন্তরালে: কী ঘটেছিল গৌরীপুরে?

ময়মনসিংহের গৌরীপুর-শ্যামগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের দু’পাশে বন বিভাগের লাগানো সারি সারি আকাশমণি আর শিশু গাছ শুধু পথের সৌন্দর্যই বাড়ায় না, স্থানীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু গত শনিবার সকালে সেই ভারসাম্যেই কুড়াল পড়ে। স্থানীয়রা দেখতে পান, গাভীশিমুল এলাকায় কয়েকটি গাছ কাটা অবস্থায় পড়ে আছে।

সচেতন এলাকাবাসীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই ছিল এই ঘটনার প্রথম ইতিবাচক দিক। তারা কেবল গাছগুলো আটকে রাখেননি, সরাসরি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ২০.৯২ ঘনফুট আয়তনের তিনটি গাছ (দুটি আকাশমণি, একটি শিশু) জব্দ করা হয়।

প্রাথমিকভাবে, এই ঘটনায় স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি, ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. শহীদুল্লাহ শহীদের নাম জড়িয়ে যায়। একটি সাধারণ অপরাধের ঘটনা মোড় নিতে যাচ্ছিল রাজনৈতিক দোষারোপের দিকে, যা আমাদের দেশে প্রায়শই ঘটে থাকে। কিন্তু সত্য চাপা থাকেনি।

তদন্তের স্বচ্ছতা এবং চাপের মুখে সততা

গৌরীপুর উপজেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমানের তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল চিত্র। তিনি জানান, এলাকার প্রভাবশালী কয়েকজনকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তার উপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। এই চাপ উপেক্ষা করে তিনি যখন স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত করেন, তখন দেখা যায়, এই গাছ কাটার মূল হোতা অন্য কেউ নন, খোদ বন বিভাগের প্রহরী মেহেদি হাসান রনি। তিনি মাত্র ১৬,৫০০ টাকায় গাছগুলো লালু বেপারী নামের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। টাকায় বিক্রি হলো পরিবেশ

এই ঘটনায় দুটি বিষয় লক্ষণীয়:

১. দুর্নীতির গভীরতা: যে ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রীয় সম্পদ অর্থাৎ আমাদের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব, তিনিই যখন সামান্য কিছু টাকার লোভে সেই সম্পদ ধ্বংস করেন, তখন বুঝতে হবে দুর্নীতির শিকড় কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে।

২. সততার শক্তি: চাপের মুখেও একজন কর্মকর্তার সত্য উদঘাটনের চেষ্টা প্রমাণ করে, সিস্টেমের ভেতরে এখনো আশার আলো নিভে যায়নি। এই ধরনের কর্মকর্তাদের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা প্রদান অত্যন্ত জরুরি।

শুধু কি একজন প্রহরীর দোষ? একটি সিস্টেমের ব্যর্থতা

মেহেদি হাসান রনিকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এটি একটি প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখানেই কি গল্পের শেষ? এই ঘটনাকে যদি আমরা শুধু একজন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রহরীর বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসেবে দেখি, তবে আমরা মূল সমস্যা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেব।

আমাদের ভাবতে হবে:

  1. একজন বন প্রহরী কেন এই ধরনের অপরাধ করতে সাহস পায়? অপর্যাপ্ত বেতন, দুর্বল তদারকি, নাকি বিচারহীনতার সংস্কৃতি তাকে এই পথে ঠেলে দিয়েছে?
  2. মাত্র ১৬,৫০০ টাকার জন্য যে তিনটি গাছ কাটা হলো, তার প্রকৃত পরিবেশগত মূল্য কত? এই গাছগুলো যে পরিমাণ অক্সিজেন দিত, কার্বন শোষণ করত, জীববৈচিত্র্যকে আশ্রয় দিত এবং মাটির ক্ষয় রোধ করত—তার আর্থিক মূল্য কি পরিমাপ করা সম্ভব?
  3. এই ঘটনাটি কি আমাদের বন ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা ব্যবস্থার পদ্ধতিগত দুর্বলতাকে প্রকাশ করে না?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজলেই আমরা বুঝতে পারব, এটি শুধু একজন রনির গল্প নয়, এটি একটি সিস্টেমের ব্যর্থতার গল্প। যেখানে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি এখনো যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে तात्ক্ষণিক আর্থিক লাভ বড় হয়ে দেখা দেয়।

বড় চিত্র: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধ

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, এবং ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক ঢাল হলো বন ও সবুজ বেষ্টনী। প্রতিটি গাছ এই যুদ্ধে এক একজন সৈনিকের মতো।

যখন আমরা নিজেদের হাতেই এই সৈনিকদের হত্যা করি, তখন আমরা প্রকারান্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করি। গৌরীপুরের তিনটি গাছ হয়তো জাতীয় পরিসরে খুব বড় সংখ্যা নয়, কিন্তু সারা দেশে এমন হাজারো ‘রনি’ যখন প্রতিনিয়ত একটি-দুটি করে গাছ কাটছে, তখন তা এক ভয়াবহ জাতীয় সংকটে পরিণত হয়। এই ছোট ছোট চুরির সমষ্টিই আমাদের বনভূমি উজাড় হওয়ার এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।

শেষ কথা

গৌরীপুরের ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। বন প্রহরীকে চাকরিচ্যুত করা একটি সঠিক পদক্ষেপ, কিন্তু এটি চূড়ান্ত সমাধান নয়। চূড়ান্ত সমাধান নিহিত আছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনে, সিস্টেমের সংস্কারে এবং আইনের কঠোর প্রয়োগে।

আমাদের বন রক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, বেতন এবং তাদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে, গৌরীপুরের সচেতন এলাকাবাসীর মতো সাধারণ মানুষকেও পাহারাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। যখন রক্ষক এবং সাধারণ মানুষ এক হয়ে কাজ করবে, তখনই আমাদের বন ও পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে। নইলে, এমন ‘রক্ষক’ নামধারী ভক্ষকদের হাতে আমাদের সবুজ ভবিষ্যৎ একটু একটু করে শেষ হয়ে যাবে।

আপনার মতামত কী?

আপনার এলাকায় কি কখনো সরকারি গাছ বা বনভূমি চুরির এমন ঘটনা দেখেছেন? এই ধরনের অপরাধ রুখতে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আপনার মূল্যবান মতামত নিচের কমেন্ট বক্সে জানান।

পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবেলা, বন ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা প্রাতিষ্ঠানিক সমাধানের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের সবুজ বাংলাকে রক্ষা করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ