24.9 C
Bangladesh
বৃহস্পতিবার, জুলাই ১০, ২০২৫
spot_img

পদ্মা-যমুনার পানি বাড়ছে, কিন্তু বন্যার ভয় নেই?

বর্ষার এই সময়ে নদ-নদীর পানি বাড়াটা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। সম্প্রতি দেশের প্রধান নদ-নদী, বিশেষ করে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি বাড়ছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। সুখবর হলো, এই পানি এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং বড় ধরনের বন্যার কোনো আশঙ্কা আপাতত নেই। পদ্মা-যমুনার পানি বাড়ছে

কিন্তু এই আপাত স্বস্তির খবরের আড়ালে কি কোনো গভীরতর বার্তা লুকিয়ে আছে? ফেনীতে মাত্র ৬ ঘণ্টায় ২২২ মিলিমিটার বৃষ্টি, উপকূলীয় অঞ্চলে অস্বাভাবিক জোয়ার এবং দেশের প্রধান নদীগুলোর খামখেয়ালি আচরণ—এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো যখন এক সুতোয় গাঁথা হয়, তখন আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এক অমোঘ বাস্তবতা: আমাদের পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, এবং এর পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন-এর নীরব কিন্তু শক্তিশালী হাত। পদ্মা-যমুনার পানি বাড়ছে

চলুন, এই খবরের গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখি, কেন বন্যার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই।

ঘটনাপ্রবাহ: কী ঘটছে আমাদের নদ-নদীগুলোতে?

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে ভারী বৃষ্টি এবং উজানের পানির কারণে প্রধান নদীগুলোর পানি বাড়ছে।

  1. ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা: এই নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে এবং আগামী তিন দিন তা অব্যাহত থাকতে পারে।
  2. গঙ্গা ও পদ্মা: এই নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি আগামী পাঁচ দিন পর্যন্ত চলতে পারে।
  3. উপকূলীয় নদী: চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী, মুহুরী, হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরীর মতো নদীগুলোর পানিও বাড়ছে। বিশেষ করে মুহুরী নদীর পানি বাড়ায় ফেনীর নিম্নাঞ্চল সাময়িকভাবে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে দেশের ভেতরে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, ফেনীতে মাত্র ৬ ঘণ্টায় ২২২ মিলিমিটার বৃষ্টির মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা এর অন্যতম উদাহরণ। পদ্মা-যমুনার পানি বাড়ছে

বিশ্লেষণ: এটি কি শুধুই একটি সাধারণ বর্ষার চিত্র?

উত্তরটি হলো, না। এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না। এর পেছনে কাজ করছে জলবায়ু পরিবর্তন-এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব, যা আমাদের আবহাওয়ার চরিত্রকেই বদলে দিচ্ছে।

১. চরম আবহাওয়ার নতুন বাস্তবতা (Extreme Weather Events)

জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণগুলোর একটি হলো আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা। ফেনীর ঘটনাটি এর একটি পাঠ্যবইয়ের উদাহরণ। অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ বৃষ্টিপাত—একেই বলে ‘এক্সট্রিম রেইনফল ইভেন্ট’। আগে যেখানে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হয়ে ধীরে ধীরে পানি বাড়ত, এখন সেখানে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই শহর বা গ্রাম প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বা গ্রামীণ অবকাঠামো এই আকস্মিক এবং বিপুল পরিমাণ পানি ধারণ করতে পারছে না। ফলে বন্যা না হলেও স্থানীয় পর্যায়ে জলাবদ্ধতা এবং আকস্মিক প্লাবনের ঘটনা বাড়ছে।

২. নদীর খামখেয়ালি আচরণ এবং অনির্দেশ্য ভবিষ্যৎ

অতীতে বাংলাদেশের মানুষ নদীর আচরণ সম্পর্কে একটি ধারণা রাখতে পারত। কখন পানি বাড়বে, কখন কমবে—তার একটি নির্দিষ্ট ঋতুভিত্তিক ছন্দ ছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সেই ছন্দকে নষ্ট করে দিয়েছে।

  1. অনিয়মিত বর্ষা: বর্ষা এখন আর অনুমানযোগ্য নয়। এর আগমন ও প্রস্থানের সময় বদলে যাচ্ছে, বৃষ্টিপাতের ধরনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
  2. উজানের প্রভাব: হিমালয়ের বরফগলা পানির হার এবং উজানের দেশগুলোতে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাওয়ায় আমাদের নদীগুলোর পানিপ্রবাহও অনিয়মিত হয়ে পড়ছে।

আজ বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে বন্যার আশঙ্কা নেই, যা অবশ্যই একটি স্বস্তির খবর। কিন্তু এই পূর্বাভাস মাত্র কয়েক দিনের। দীর্ঘমেয়াদী চিত্রটি কিন্তু বেশ উদ্বেগজনক। নদীর এই খামখেয়ালি আচরণ আমাদের কৃষি, মৎস্য সম্পদ এবং নদী তীরবর্তী কোটি মানুষের জীবনযাত্রাকে এক অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

৩. উপকূলের দ্বিমুখী সংকট

খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, সাগরে লঘুচাপের কারণে উপকূলীয় নদীগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জোয়ার বইছে। এটিও জলবায়ু পরিবর্তন-এর একটি প্রত্যক্ষ ফল। একদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরে প্রায়ই শক্তিশালী লঘুচাপ ও নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে। এর ফলে উঁচু জোয়ারের পানি নদীর মিঠাপানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। অর্থাৎ, উপকূলীয় অঞ্চলগুলো এখন দ্বিমুখী চাপের মধ্যে রয়েছে—উজানের মিঠাপানি এবং সমুদ্রের নোনা পানি। এই পরিস্থিতি উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি, সুপেয় পানি এবং সামগ্রিক পরিবেশ-এর জন্য একটি মারাত্মক হুমকি।

শেষ কথা: স্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সতর্কবার্তা

পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনার পানি বাড়ছে, কিন্তু বড় বন্যার আশঙ্কা নেই—এই খবরটি আমাদের সাময়িক স্বস্তি দিলেও আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। এটি ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থার মতো। আমাদের বুঝতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর কোনো ভবিষ্যতের বিষয় নয়, এটি আমাদের বর্তমান।

ফেনীর আকস্মিক প্লাবন, নদীর অনিয়মিত আচরণ এবং উপকূলের সংকট—এই সবগুলোই একটি বড় ছবির অংশ। এই ছবিটি হলো এক বিপর্যস্ত পরিবেশ এবং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের। আমাদের এখন শুধু স্বল্পমেয়াদী পূর্বাভাসের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে আমাদের পরিবেশ রক্ষা, টেকসই নগর পরিকল্পনা এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে মনোযোগ দিতে হবে।

কারণ, আজ যে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে যাচ্ছে, জলবায়ুর এই খামখেয়ালিপনায় কাল তা ভয়াল রূপ নিতে কতক্ষণ?

আপনার মতামত কী?

আপনার এলাকায় আবহাওয়ার ধরনে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন? জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? আপনার ভাবনা আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পোস্টটি শেয়ার করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ