25.7 C
Bangladesh
শুক্রবার, জুলাই ১১, ২০২৫
spot_img

এই জলাবদ্ধতায় আপনার শহর কেন ডুবছে?

বর্ষা মানেই কি এখন আর রোমান্টিকতা? নাকি একরাশ আতঙ্ক আর ভোগান্তি? গত কয়েকদিনের চিত্র দেখলে দ্বিতীয়টিকেই সত্যি বলে মনে হবে। বান্দরবানে ২৭১ মিলিমিটার বৃষ্টি, নোয়াখালীর মাইজদী শহর পানির নিচে, চট্টগ্রামের নিচু এলাকাগুলোয় হাঁটু পানি—এই খবরগুলো এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি এখন বাংলাদেশের বর্ষাকালের ‘নতুন বাস্তবতা‘। জলাবদ্ধতায় আপনার শহর

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বঙ্গোপসাগরের লঘুচাপ আর সক্রিয় মৌসুমী বায়ুই এই ভারী বর্ষণের কারণ। কিন্তু এর পেছনের আসল কারণ কী? কেন সামান্য কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই আমাদের শহরগুলো অচল হয়ে পড়ছে? এই জলাবদ্ধতা কি কেবলই অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফল, নাকি এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন-এর মতো এক অদৃশ্য শত্রু কাজ করছে? চলুন, সংবাদের পাতা থেকে বাস্তবতার গভীরে যাওয়া যাক। জলাবদ্ধতায় আপনার শহর

ভোগান্তির জাতীয় চিত্র: যখন বৃষ্টি মানেই বিপর্যয়

খবরের দিকে তাকালে একটি সমন্বিত সংকটের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নোয়াখালীতে প্রধান সড়ক ছাড়া বাকি সব ডুবে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, বাকলিয়ার মতো বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে। পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলার মতো উপকূলীয় জেলাগুলোতে মানুষের জীবনযাত্রা থমকে গেছে। ভোলায় ১৬ হাজার হেক্টরের বেশি ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে, যা কৃষকদের মাথায় হাত ফেলার জন্য যথেষ্ট।

এই প্রতিটি ঘটনাই একেকটি সতর্কবার্তা। ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেনের দোকানের সামনের রাস্তা অল্প বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়াটা শুধু তার একার সমস্যা নয়, এটি আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার প্রতীক। অন্যদিকে, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র যখন পদ্মা-যমুনার পানি বাড়ার কথা বলে, তখন বোঝা যায়, এই সংকট শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নেই; এটি গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হতে চলেছে। জলাবদ্ধতায় আপনার শহর

কেন ডুবছে আমাদের শহর? পরিবেশগত আত্মহনন

জলাবদ্ধতার জন্য আমরা প্রায়ই দায়ী করি ভরাট হয়ে যাওয়া ড্রেন আর দখল হয়ে যাওয়া খালকে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় কারণ। আমাদের শহরগুলো অপরিকল্পিতভাবে কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। খেলার মাঠ, পার্ক, পুকুর বা জলাশয়—যেগুলো একসময় বৃষ্টির পানি ধারণ করত, সেগুলোকে ভরাট করে আমরা বহুতল ভবন তৈরি করেছি। মাটি খুঁজে না পাওয়ায় বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারে না, ফলে সমস্ত চাপ এসে পড়ে নর্দমাগুলোর ওপর, যা আগে থেকেই আবর্জনায় বন্ধ।

এটি আমাদের পরিবেশ-এর প্রতি এক ধরনের অবহেলা এবং আত্মহননের সামিল। আমরা প্রকৃতির পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। ফলে, প্রকৃতি যখন তার স্বাভাবিক নিয়মে বৃষ্টি ঝরায়, আমাদের তৈরি করা কৃত্রিম ব্যবস্থা সেই চাপ নিতে পারে না। ফলাফল—হাঁটু পানি, কোমর পানি এবং অবর্ণনীয় জনদুর্ভোগ।

জলবায়ু পরিবর্তন: সংকটের মূল চালিকাশক্তি

এখানেই জলবায়ু পরিবর্তন-এর বিষয়টি সামনে আসে। আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম যেমনটা বলেছেন, বৃষ্টির পরিমাণ হয়তো কমে আসবে, কিন্তু এই যে স্বল্প সময়ে “ভারী থেকে অতিভারী” বৃষ্টি—এটাই জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রধান লক্ষণগুলোর একটি।

আগেকার দিনে বৃষ্টি হতো ঝিরঝিরে, দীর্ঘ সময় ধরে। আমাদের নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সেই ধরনের বৃষ্টির কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে আবহাওয়ার ধরণ বদলে গেছে। এখন বৃষ্টি হয় অনেক বেশি তীব্র এবং অল্প সময়ের জন্য। একে বলা হয় “Extreme Rainfall Event”। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় যখন শত শত মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, তখন পৃথিবীর কোনো উন্নত শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমেরও সেই পানি দ্রুত নিষ্কাশন করা কঠিন হয়ে পড়ে, আর আমাদের মতো দেশের দুর্বল অবকাঠামোর তো কথাই নেই।

অর্থাৎ, সমস্যাটা দ্বিমুখী:

১. আমাদের দুর্বল ও অপরিকল্পিত নগর-পরিবেশ

২. জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে বৃষ্টির তীব্রতা ও খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণ।

এই দুইয়েরผสมে জলাবদ্ধতা এখন আর শুধু বর্ষার একটি সাধারণ সমস্যা নয়, এটি একটি ভয়াবহ দুর্যোগে পরিণত হয়েছে।

শুধু ভোগান্তি নয়, এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট

জলাবদ্ধতার প্রভাব শুধু যাতায়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। দিনের পর দিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারে না, দিনমজুর তার কাজে যোগ দিতে পারে না। সড়কের পাশের নালা থেকে নোংরা পানি আর আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ে, যা ডায়রিয়া, চর্মরোগের মতো পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ভোলার কৃষকের ফসলের ক্ষতি দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও প্রভাব ফেলে।

শেষ কথা: সমাধানের পথ কী?

এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের চিন্তার ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তা থেকে পানি সরানোর কথা ভাবলে চলবে না। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই সমাধানের দিকে এগোতে হবে।

  1. জলবায়ু-সহনশীল নগর পরিকল্পনা: নতুন করে শহর গড়ার সময় জলাশয়, সবুজ এলাকা এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করার মতো উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  2. খাল ও নদী পুনরুদ্ধার: দখল হয়ে যাওয়া খাল ও নদীগুলোকে উদ্ধার করে তাদের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।
  3. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: ড্রেনে প্লাস্টিক ও কঠিন বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

এই জলাবদ্ধতা প্রকৃতির একটি সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা। সে আমাদের বলছে, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন-কে উপেক্ষা করে উন্নয়নের যে পথে আমরা হাঁটছি, সেই পথ ভুল। এখনই যদি আমরা সঠিক পথে না ফিরি, তাহলে ভবিষ্যতে সামান্য বৃষ্টিতেই হয়তো পুরো দেশই ডুবে যাবে এক অপূরণীয় সংকটের গভীরে।

আপনার অভিজ্ঞতা কী?

আপনার এলাকাতেও কি জলাবদ্ধতার সমস্যা দিন দিন বাড়ছে? এই সংকট মোকাবেলায় আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? আপনার মতামত কমেন্ট বক্সে জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ