বিকেলের ম্লান আলোয় নদীর চরে পা রাখতেই নরম কাদায় পা ডুবে যায়। কোমরের কাছে ঠান্ডা লোনা পানির স্রোত। সেই পানির মধ্যেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল টেনে চলেছেন এক নারী। পাশে কাদার উপর বসে আছেন তার অসুস্থ স্বামী, অপলক চোখে তাকিয়ে আছেন স্ত্রীর দিকে। তিন ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে যে কয়টা চিংড়ির রেণু পোনা জালে উঠেছে, দুজন মিলে তাই গুনছেন পরম যত্নে। একশ, একশ দশ, একশ উনিশ…। এই সামান্য ক’টা পোনাই তাদের আজকের আশা। নারীদের না বলা কথা
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ছবি নয়। খুলনার কয়রার সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে কান পাতলেই এমন হাজারো না বলা কষ্টের গল্প শোনা যায়। যে গল্পে মিশে আছে বেঁচে থাকার এক তীব্র লড়াই, লোনা পানি আর একমুঠো ভাতের সম্পর্ক। নারীদের না বলা কথা
যে ঘরের ঠিকানা ছিল, আজ তা নদীর গভীরে
নদীর চরে কাদার উপর বসে কথা হচ্ছিল এমনই এক দম্পতির সঙ্গে। একসময় তাদের নিজেদের ঘর ছিল, ছিল নৌকা আর জাল। স্বামী-স্ত্রী মিলে নদীতে মাছ ধরতেন, সংসার চলত। কিন্তু এক রাতের ‘আইলা’ এসে তাদের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আজ তাদের ঠিকানা বেড়িবাঁধের ওপরের এক চিলতে ঝুপড়ি। যে ঘরে বর্ষার জোয়ারে পানি ঢুকে যায়। “গেরস্তের গরু-ছাগলও আমাদের চাইতে ভালো থাকে,”—এক চিলতে ভাঙা হাসির সাথে বেরিয়ে আসে একরাশ দীর্ঘশ্বাস। নারীদের না বলা কথা
আজ অসুস্থতার কারণে স্বামী আর জাল টানতে পারেন না। তাই সংসারের হাল ধরেছেন স্ত্রী। তার মতোই শত শত নারী আজ কোমরপানিতে নেমে চিংড়ির পোনা ধরছেন। কারণ, এই পোনা বিক্রি করেই জুটবে দিনের খাবার। এই করুণ চিত্রের পেছনে রয়েছে পরিবেশ বিপর্যয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর এক নির্মম বাস্তবতা।
জলবায়ু পরিবর্তনের অদৃশ্য শিকার
সুন্দরবন উপকূলের এই মানুষগুলো জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রথম এবং সবচেয়ে অসহায় শিকার। বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে:
১. বাড়ছে লবণাক্ততা: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের স্তর বাড়ছে। ফলে নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে হু হু করে। একসময় যে নদীতে মিঠা পানির মাছ পাওয়া যেত, আজ তা নোনা পানিতে ভরা। কৃষিজমিগুলোও লবণাক্ততার কারণে ফসল ফলানোর ক্ষমতা হারাচ্ছে। ফলে, पारंपरिक জীবিকা হারিয়ে মানুষ বাধ্য হচ্ছে চিংড়ির পোনা ধরার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামতে।
২. প্রাকৃতিক দুর্যোগের হানা: আইলা, সিডর, আম্ফানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বাড়ছে। এসব দুর্যোগে ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে মানুষ রাতারাতি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। তারা পরিণত হচ্ছে নিজ ভূমিতে “জলবায়ু উদ্বাস্তুতে”। বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের কাছে নদীর এই লোনা পানি ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকছে না।
জীবিকার দামে জীবনের বলি
এই লোনা পানি তাদের একমুঠো ভাতের জোগান দিলেও নীরবে কেড়ে নিচ্ছে অনেক কিছু। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লবণাক্ত পানিতে শরীর ডুবিয়ে রাখার ফলে নারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। চিকিৎসকদের মতে, এই অঞ্চলের নারীদের মধ্যে প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণসহ বিভিন্ন চর্মরোগ আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। অপুষ্টি আর অসচেতনতা এই বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। যে পানি তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই পানিই তাদের শরীরে মরণব্যাধির বাসা তৈরি করে দিচ্ছে।
সুন্দরবন উপকূলের প্রায় ৩০টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ আজ এই পোনা ধরার ওপর নির্ভরশীল। ফড়িয়ার হাতে হাজারখানেক পোনা তুলে দিলে মেলে গড়ে এক হাজার টাকা। সারাদিনের খাটুনির পর কারও আয় হয় ২০০ টাকা, কারও ৩০০। এই সামান্য আয় দিয়েই চলে জীবন, কাটে রাত। তারা জানেন, এই লোনা পানিতে লুকিয়ে আছে কষ্ট আর রোগ। তবু তারা জাল ছাড়তে পারেন না, কারণ এই একমুঠো পোনাই তাদের কাছে একমুঠো ভাতের সমার্থক।
শেষ কথা: এই লড়াই শুধু তাদের নয়
যখন আমরা পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলি, তখন আমাদের চোখের সামনে বড় বড় পরিসংখ্যান, বরফ গলার ছবি বা কার্বন নিঃসরণের গ্রাফ ভেসে ওঠে। কিন্তু এর আড়ালে যে হাজারো মানুষের নীরব কান্না আর অস্তিত্বের লড়াই লুকিয়ে আছে, তা আমরা অনেক সময়ই দেখি না।
সুন্দরবনের এই নারীরা সেই লড়াইয়ের একেকজন সৈনিক। তারা এমন এক যুদ্ধের শিকার, যা তারা শুরু করেননি। তাদের এই লোনা পানিতে ডোবা জীবন আমাদের জন্য একটি শক্তিশালী সতর্কবার্তা। এটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কোনো দূর ভবিষ্যতের বিষয় নয়, এটি বর্তমানেই বহু মানুষের জীবনকে নরকে পরিণত করেছে। তাদের এই একমুঠো ভাতের লড়াই আসলে আমাদের সবার সম্মিলিত ব্যর্থতারই প্রতিচ্ছবি।
আপনার মতামত কী?
এই মানুষগুলোর গল্প কি আপনাকে ভাবাচ্ছে? পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর মানবিক সংকট মোকাবেলায় আমাদের ঠিক কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান এবং এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অংশ নিন।