28.8 C
Bangladesh
রবিবার, জুলাই ১৩, ২০২৫
spot_img

মাঠজুড়ে পানি, কৃষকের চোখে জল

একদিকে যখন আমরা নগরজীবনের ব্যস্ততায় ডুবে আছি, অন্যদিকে বাংলাদেশের ২১টি জেলার হাজার হাজার কৃষক তাকিয়ে আছেন তাদের ডুবন্ত ফসলের দিকে। যে মাঠে কয়েক দিন আগেও সোনালি আউশ ধান দুলছিল, যে সবজিখেত ঘিরে ছিল পরিবারের স্বচ্ছলতার স্বপ্ন, আজ সেখানে থইথই করছে ঘোলা পানি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারী বৃষ্টিতে দেশের প্রায় ৭২ হাজার ৭৬ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকের চোখে জল

এটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়। এটি হাজার হাজার কৃষকের সারা বছরের পরিশ্রম, ঋণ করে কেনা সার-বীজ আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন পানিতে ভেসে যাওয়ার এক করুণ চিত্র। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভয়াবহ ক্ষতির জন্য আমরা কি শুধু বৃষ্টিকে দায়ী করব? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর কোনো সংকট? চলুন, এই জলাবদ্ধতার গভীরে ডুব দিয়ে আসল সত্যটা খুঁজে বের করি। কৃষকের চোখে জল

পরিসংখ্যানের আয়নায় ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা

কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ২১টি জেলা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালীর মতো জেলাগুলোর কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

  1. সবচেয়ে বেশি ক্ষতি কুমিল্লায়: এই জেলার প্রায় ১১,৫৯০ হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে। এর মধ্যে আছে আউশ ধান, আমনের বীজতলা, শাকসবজি এবং আখ।
  2. নোয়াখালীর চিত্রও করুণ: এখানে প্রায় ৭,৮০৬ হেক্টর জমির আউশ, আমন, শাকসবজি এমনকি তরমুজের খেতও ডুবে গেছে।
  3. সারাদেশে প্রভাব: সব মিলিয়ে ৪৪ হাজার হেক্টরের বেশি আউশ ধান, ১৪ হাজার হেক্টরের বেশি আমনের বীজতলা এবং প্রায় ৯,৬৭৩ হেক্টর জমির শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর সাথে আছে পান, পেঁপে, কলাসহ আরও অনেক অর্থকরী ফসল।

এই সংখ্যাগুলো শুধু ফসলের হিসাব নয়, এগুলো প্রতিটি কৃষক পরিবারের দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি। কৃষকের চোখে জল

বৃষ্টি নাকি জলবায়ু পরিবর্তন?

আমরা প্রায়শই এমন দুর্যোগকে “প্রাকৃতিক” বলে দায় এড়িয়ে যাই। কিন্তু আসলেই কি তাই? এখানেই জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গটি চলে আসে। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার আচরণ চরম খামখেয়ালি হয়ে উঠবে। এবারের ঘটনা ঠিক সেই সতর্কবার্তারই একটি বাস্তব প্রতিফলন।

লক্ষ্য করুন, এখন আর আগের মতো দিনের পর দিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয় না। যা হয়, তা হলো অল্প সময়ে অতি ভারী বর্ষণ (Extreme Rainfall Event)। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এটি এখন আগের চেয়ে বেশি জলীয় বাষ্প ধারণ করতে পারে। ফলে যখন বৃষ্টি নামে, তখন আকাশ যেন একেবারে ভেঙে পড়ে। আমাদের নদী-নালা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা এই আকস্মিক বিপুল পরিমাণ পানি ধারণ করতে পারে না। ফলাফল? ভয়াবহ জলাবদ্ধতা এবং ফসলের মাঠ ডুবে যাওয়া।

তাই এই দুর্যোগকে শুধু “ভারী বৃষ্টি” বললে ভুল হবে। এটি আসলে জলবায়ু পরিবর্তন-এর একটি সরাসরি প্রভাব, যা আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে এক চরম ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

পরিবেশের ওপর আমাদের আঘাত: সংকট যখন দ্বিগুণ

জলবায়ু পরিবর্তন যদি সংকটের একটি দিক হয়, তবে অপর দিকটি হলো আমাদের নিজেদের হাতে তৈরি করা পরিবেশ বিপর্যয়। আমরা উন্নয়নের নামে গত কয়েক দশকে আমাদের প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থাগুলোকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছি।

  1. নদী ও খালের মৃত্যু: দেশের অধিকাংশ নদী ও খাল দখল ও দূষণের শিকার। অনেক খাল ভরাট করে বড় বড় স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি নদী পর্যন্ত গড়ানোর পথ খুঁজে পায় না।
  2. জলাশয় ভরাট: শহর ও গ্রামের অসংখ্য পুকুর, দিঘি ও জলাভূমি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এই জলাভূমিগুলো স্পঞ্জের মতো অতিরিক্ত পানি শোষণ করে বন্যা থেকে রক্ষা করত। সেই স্পঞ্জ আজ আর নেই।

বিষয়টা অনেকটা এমন: একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের ওপর বিপুল পরিমাণ পানি ঢেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে আমরা আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করে সেই পানি সরে যাওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছি। এই দ্বিমুখী আক্রমণের সামনে আমাদের কৃষি এবং কৃষকের টিকে থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

শেষ কথা: সতর্কবার্তা শোনার এখনই সময়

৭২ হাজার হেক্টর জমির ফসল ডুবে যাওয়া শুধু একটি বছরের ফসলের ক্ষতি নয়। এটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি অশনিসংকেত। এটি একটি সতর্কবার্তা যে, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন-কে আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

এখনই সময় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার। একদিকে যেমন জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে হবে, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, তেমনি অন্যদিকে আমাদের নদী-খাল-জলাশয়গুলোকে দখলমুক্ত করে তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে। নইলে প্রতি বছর এমন দুর্যোগ আসবে, আর আমরা শুধু অসহায় হয়ে কৃষকের কান্না দেখব। এই কান্না শুধু কৃষকের নয়, এই কান্না পুরো বাংলাদেশের ভবিষ্যতের।

আপনার মতামত কী?

পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন-এর এমন প্রভাব কি আপনি আপনার এলাকাতেও দেখছেন? এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের ঠিক কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান ভাবনা আমাদের সাথে শেয়ার করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ