27.8 C
Bangladesh
রবিবার, জুলাই ১৩, ২০২৫
spot_img

মৃত খাল কি পারবে বরিশালকে বাঁচাতে?

ভাবুন তো একবার, যে শহরকে একসময় ডাকা হতো “প্রাচ্যের ভেনিস” বলে, যার শিরা-উপশিরায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিল স্বচ্ছ পানির খাল, সেই শহর আজ সামান্য বৃষ্টিতেই পানির নিচে তলিয়ে যায়। মানুষের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে নোংরা পানি, রাস্তাঘাট পরিণত হয় খালে। বলছি বরিশাল শহরের কথা। এক সময়ের খাল আর নদীর প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই নগরী আজ জলাবদ্ধতার অভিশাপে ধুঁকছে। মৃত খাল

গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে বরিশালের মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। যেখানে ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসেও অনেক বাড়িতে পানি ওঠেনি, সেখানে এখনকার সাধারণ বৃষ্টিতেই শহরজুড়ে হাঁটুপানি। এই করুণ পরিণতি কি একদিনে হয়েছে? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার এক লম্বা ইতিহাস? চলুন, এই জলাবদ্ধতার গভীরে ডুব দিয়ে দেখি আসল কারণটা কী এবং এর থেকে মুক্তির পথই বা কোথায়। মৃত খাল

সমস্যার মূল: কোথায় হারাল সেই ২৪টি খাল?

বরিশালের জলাবদ্ধতার মূল কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে শহরের মানচিত্রের দিকে, যা সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে। একসময় এই শহরে ছিল ২৪টি প্রধান খাল এবং অসংখ্য সংযুক্ত শাখা-প্রশাখা। ছিল প্রায় তিন হাজারেরও বেশি পুকুর ও দিঘি। এগুলো ছিল শহরের প্রাকৃতিক ড্রেনেজ সিস্টেম বা পানি নিষ্কাশনের শিরা-উপশিরা। ভারী বৃষ্টি হলেও এই খাল ও জলাশয়গুলো দ্রুত পানি ধারণ করে নদী পর্যন্ত পৌঁছে দিত।

কিন্তু আজ সেই ২৪টি খালের মধ্যে মাত্র ৮টির আংশিক অস্তিত্ব টিকে আছে। জেল খাল, সাগরদী, লাকুটিয়া খালের মতো যে কয়েকটি খাল এখনো বেঁচে আছে, সেগুলোও দখল আর দূষণের ভারে মৃতপ্রায়। বাকি খালগুলো—যেমন নাপিতখালী, ভাটার খাল, চাঁদমারী—এখন শুধুই নাম। কোথায় গেল এই খালগুলো? উত্তরটা আমাদের সবার জানা, কিন্তু মানতে কষ্ট হয়। মৃত খাল

এই খাল ও জলাশয়গুলো ভরাট করে গড়ে উঠেছে বড় বড় দালানকোঠা, দোকানপাট আর আবাসন। পরিবেশ-এর কথা না ভেবে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের নেশায় আমরা নিজ হাতে শহরের শ্বাস নেওয়ার পথগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। বরিশাল নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক কাজী মিজানুর রহমানের কথায় সেই আক্ষেপই ফুটে ওঠে, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে খালগুলো দখলমুক্ত করতে দাবি জানালেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন।” এই উদাসীনতাই আজ পুরো শহরকে ডুবিয়ে মারছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের খড়্গ: কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা

আমরা যখন নিজ হাতে আমাদের শহরের পরিবেশ ধ্বংস করেছি, ঠিক তখনই প্রকৃতিও তার রুদ্রমূর্তি দেখাতে শুরু করেছে। এখানেই চলে আসে জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রসঙ্গ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বৃষ্টির ধরন বদলে গেছে। আগে হয়তো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হতো লম্বা সময় ধরে। কিন্তু এখন অল্প সময়ে অতি ভারী বর্ষণ (Extreme Rainfall) হচ্ছে।

ভাবুন, যে শহরের পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথগুলো আমরা আগেই বন্ধ করে দিয়েছি, সেই শহরের ওপর যদি হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ পানি এসে পড়ে, তাহলে কী হবে? ঠিক তাই হচ্ছে বরিশালে। একদিকে দখল হয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় খাল, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট আকস্মিক ভারী বৃষ্টি—এই দুইয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন নগরবাসী। এটা অনেকটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। আমরা নিজেরাই ক্ষত তৈরি করেছি, আর জলবায়ু পরিবর্তন সেই ক্ষতে লবণ ছিটিয়ে দিচ্ছে।

আশার আলো: ৭০১ কোটি টাকার খাল পুনরুদ্ধার প্রকল্প

অন্ধকারের শেষে যেমন আলো থাকে, তেমনি এই ভয়াবহ সংকটের মাঝেও এক চিলতে আশা দেখা যাচ্ছে। বরিশাল সিটি করপোরেশন শহরের মৃতপ্রায় খালগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য ৭০১ কোটি টাকার একটি বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আনন্দের বিষয় হলো, অর্থ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পে অর্থায়নের অনুমোদন দিয়েছে।

এই প্রকল্পের আওতায় নগরের ২৯টি খালের পুনঃখনন, পাড় সংরক্ষণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। যদি এই প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি হতে পারে বরিশালকে বাঁচানোর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী যেমনটা বলেছেন, “নগরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণে এটি বড় অগ্রগতি।”

কিন্তু সাবধান! টাকা ঢালাই কি যথেষ্ট?

প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে, টাকাও আসবে। কিন্তু এখানেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? পরিবেশবাদীরা কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগের সমন্বয়কারী রফিকুল আলমের মতে, শুধু খাল খনন করলেই হবে না।

প্রথমত, প্রতিটি খালের সীমানা সঠিকভাবে নির্ধারণ করে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করতে হবে। খালের উৎস এবং শেষ মাথায় যেসব প্রভাবশালী স্থাপনা পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, সেগুলো অপসারণ না করলে এই খনন হবে অর্থহীন। দ্বিতীয়ত, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরুর আগে সাধারণ মানুষ, পরিবেশবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদদের মতামত নেওয়া জরুরি। নইলে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও ভেস্তে যেতে পারে।

শেষ কথা: বরিশাল হোক আমাদের জন্য এক শিক্ষা

বরিশালের এই গল্প শুধু একটি শহরের গল্প নয়। এটি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরের প্রতিচ্ছবি। আমরা উন্নয়নের নামে যেভাবে নদী, খাল, জলাশয় ধ্বংস করে কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি করছি, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিই হলো এই জলাবদ্ধতা।

বরিশালের খাল পুনরুদ্ধার প্রকল্প যদি সফল হয়, তবে তা অন্য শহরগুলোর জন্য একটি মডেল হতে পারে। এটি প্রমাণ করবে যে, সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো ধ্বংসস্তূপ থেকেও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠা সম্ভব। তবে এই সফলতা নির্ভর করছে স্বচ্ছতা, সঠিক পরিকল্পনা এবং সব ধরনের প্রভাবশালীদের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার মানসিকতার ওপর। নইলে প্রাচ্যের ভেনিস নামটা শুধু বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, বাস্তবে ভেসে বেড়াবে এক অন্তহীন দুর্ভোগ।

আপনার মতামত কী?

আপনার মতে, বরিশালের এই প্রকল্প সফল করতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনটি? আপনার এলাকার পরিবেশ রক্ষায় এবং জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? কমেন্টে আপনার মূল্যবান মতামত জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ