28.8 C
Bangladesh
রবিবার, জুলাই ১৩, ২০২৫
spot_img

গোমতীর পানি কমল, কিন্তু বিপদ কি সত্যিই কেটেছে?

গত কয়েকটা দিন কুমিল্লার গোমতীর পাড়ের মানুষেরা ঠিকমতো ঘুমাতে পেরেছিলেন কি না, সন্দেহ আছে। টানা বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের যুগলবন্দীতে ফুঁসে উঠেছিল গোমতী নদী। নদীর পানি হু হু করে বাড়ছিল, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মানুষের আতঙ্ক। গত বছরের বাঁধ ভাঙার দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়াচ্ছিল সবাইকে। অনেকে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে শুধু নদীর দিকে চেয়ে থেকে। গোমতীর পানি কমল

তবে সুখবর হলো, গত দুই দিন ধরে গোমতীর তেজ কমতে শুরু করেছে। উজান থেকে আসা পানির স্রোত কমেছে, বৃষ্টিও আপাতত বিদায় নিয়েছে। নদীর পানি বিপৎসীমার বেশ খানিকটা নিচে নেমে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। যে আতঙ্ক মেঘের মতো জমেছিল, তা আপাতত কেটে গিয়ে এক চিলতে স্বস্তির রোদ উঁকি দিয়েছে। গোমতীর পানি কমল

ঘটনার ভেতরের ঘটনা: পরিসংখ্যান কী বলছে?

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লার গোমতী নদীর পানির বিপৎসীমার স্তর হলো ১১.৩০ মিটার। বৃহস্পতিবার সকালেও নদীর পানি ৯.৬৮ মিটার পর্যন্ত উঠেছিল, যা বিপৎসীমার খুব কাছাকাছি না হলেও মানুষের মনে ভয় ধরানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।

কিন্তু এরপর থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। শুক্রবার বিকেল নাগাদ পানি নেমে আসে ৮.৪৮ মিটার স্তরে। অর্থাৎ, মাত্র ৩৩ ঘণ্টায় পানি কমেছে প্রায় ১.২০ মিটার বা চার ফুট! বর্তমানে বিপৎসীমার প্রায় ৯ ফুট নিচ দিয়ে শান্তভাবে বয়ে চলেছে গোমতী। এই পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো এবং নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক।

নদীপাড়ের মানুষের কথাতেও সেই স্বস্তির সুর। আদর্শ সদরের অরণ্যপুর এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেনের সহজ স্বীকারোক্তি, “ভাবছিলাম, এইবারও গাঙ্গের পানি আমরার সব ভাসাইয়া লইয়্যা যাইব। তয় দুই দিন ধইরা পানি বাড়তাছে না। আল্লাহ আমরারে রক্ষা করছে।” বুড়িচংয়ের মোতালেব হোসেনও একই সুরে বলেন, “পানি কমছে এটাই বড় স্বস্তির খবর। মানুষের মধ্যে যে উৎকণ্ঠা ছিল, সেটা অনেকটা কেটে গেছে।”

কিন্তু আসল প্রশ্নটা অন্য জায়গায়: এই স্বস্তি কি স্থায়ী?

গোমতীর পানি কমে যাওয়ায় আমরা সাময়িকভাবে স্বস্তি পেতেই পারি। কিন্তু একটু গভীরে তাকালে এই ঘটনা আমাদের জন্য কিছু বড় এবং জরুরি প্রশ্ন রেখে যায়। এই আকস্মিক পানি বৃদ্ধি এবং তারপর দ্রুত কমে যাওয়া কি শুধুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও বড় কোনো অশনিসংকেত? এখানেই পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গটি চলে আসে।

গোমতীর এই পানি বৃদ্ধিকে বলা যায় জলবায়ু পরিবর্তন-এর একটি ছোট ট্রেইলার। বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়ার আচরণ খামখেয়ালি হয়ে উঠবে। অসময়ে ভারী বৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, আবার কখনও দীর্ঘ খরা—এগুলোই হবে নতুন বাস্তবতা। এবারের ঘটনাটা ঠিক সেই চিত্রকেই তুলে ধরেছে। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি এবং উজানের ঢলে নদীর পানি যেভাবে আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছিল, তা স্বাভাবিক বর্ষার আচরণের সঙ্গে মেলে না। এটি একটি চরম আবহাওয়ার (Extreme Weather Event) উদাহরণ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ফল।

প্রকৃতির ওপর মানুষের আঘাত: जख्म যখন দ্বিগুণ

বিষয়টি শুধু জলবায়ু পরিবর্তন-এর একতরফা খেলা নয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আমাদের নিজেদের তৈরি করা বিপদ। বুড়িচংয়ের বাসিন্দা মোতালেব হোসেনের কথায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। তিনি বলেন, “বিগত সময়ে মাটিখেকোরা গোমতী চরের মাটি লুট করে নিয়ে চরকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। যার কারণে পানি বাড়লে বিপৎসীমার নিচে থাকলেও চরের অনেক কৃষিজমি তলিয়ে যায়।”

এই কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর আচরণ বদলে যাচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন আর অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা নদীকে আরও দুর্বল করে ফেলছি। নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তার ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে, সামান্য অস্বাভাবিক বৃষ্টি বা ঢলেই নদী ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। এটি একটি দ্বিমুখী সংকট: প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা এবং আমাদের অপরিণামদর্শিতা। এই দুইয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে নদীপাড়ের সাধারণ মানুষ।

শেষ কথা: সতর্কবার্তা কি আমরা শুনছি?

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবেদ আলী জানিয়েছেন, আপাতত বন্যার কোনো শঙ্কা নেই এবং পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এটি অবশ্যই ভালো খবর। কিন্তু আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই।

গোমতীর এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। এটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন কোনো দূর ভবিষ্যতের তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, এটি আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আজ গোমতীর পানি কমেছে, কিন্তু আমাদের কপালের ভাঁজ কি কমেছে?

এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় শুধু तात्ক্ষণিক ত্রাণ বা উদ্ধার তৎপরতাই যথেষ্ট নয়। আমাদের ভাবতে হবে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নিয়ে। নদীর নাব্য রক্ষা, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা, নদীপাড়ের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কৌশল নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি। নইলে আজ গোমতীর পানি কমে স্বস্তি দিলেও, কাল হয়তো অন্য কোনো নদীর রুদ্ররূপে আমাদের ঘুম ভাঙবে।

আপনার মতামত কী?

পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আপনার ভাবনা কী? গোমতীর মতো এমন ঘটনা মোকাবেলায় আমাদের আর কী কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান। পরিবেশগত ঝুঁকি ও তার সমাধান নিয়ে আরও জানতে আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ