27.8 C
Bangladesh
রবিবার, জুলাই ১৩, ২০২৫
spot_img

সাভারে এক লাখ গাছ কি শুধুই ফটোসেশন?

ঢাকার বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াটা যেন এক যুদ্ধ। ধুলো, ধোঁয়া আর দূষণের চাদরে মোড়া এই শহর আর তার আশপাশের এলাকাগুলো যখন একটুখানি সবুজের জন্য হাহাকার করছে, ঠিক তখনই সাভার থেকে এলো এক দারুণ আশার খবর। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং দেশের অন্যতম শীর্ষ পরিবেশকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ডাক দিয়েছেন এক সবুজ বিপ্লবের। গাছ কি শুধুই ফটোসেশন

‘সবুজে বাঁচুক সাভার, নীল আকাশে উড়ুক স্বপ্ন হাজার’—এই সুন্দর স্লোগানকে সামনে রেখে সাভারে এক দিনে রোপণ করা হয়েছে এক লাখ গাছের চারা! নিঃসন্দেহে এটি একটি বিশাল এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই এক লাখ গাছই কি আমাদের বিষাক্ত বাতাসকে বিশুদ্ধ করে দেবে? এই উদ্যোগ কি শুধুই একটি সুন্দর ছবির জন্য, নাকি এর পেছনে রয়েছে টেকসই পরিবেশ রক্ষার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা?

চলুন, এই সবুজ উদ্যোগকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

কেন এই উদ্যোগ এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কথাটি অত্যন্ত স্পষ্ট: “আমরা যদি প্রকৃতিকে ধ্বংস করি, প্রকৃতিও আমাদের রক্ষা করবে না।” ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকাগুলো, বিশেষ করে সাভার, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং নগরায়ণের চাপে পিষ্ট। এখানকার বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এবং ধুলাবালির ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাছ কি শুধুই ফটোসেশন

এই কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে ‘বেটার ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট ইনিশিয়েটিভস’-এর মতো একটি কর্মসূচি অত্যন্ত সময়োপযোগী। এটি শুধু কিছু গাছ লাগানোর আয়োজন নয়, এটি দূষণের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা। যখন একজন দায়িত্বশীল উপদেষ্টা নিজে কাঁঠালগাছের চারা রোপণ করে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন, তখন এটি সাধারণ মানুষের কাছেও একটি জোরালো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এই উদ্যোগ প্রমাণ করে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। গাছ কি শুধুই ফটোসেশন

গাছ লাগানো: সমাধানের শুরু, শেষ নয়

এক দিনে এক লাখ গাছ লাগানো নিঃসন্দেহে একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, উপদেষ্টার নিজের কথাতেই এর আসল চ্যালেঞ্জটি লুকিয়ে আছে। তিনি বলেছেন, “শুধু চারাগাছ লাগালেই হবে না, তা রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব।”

এটিই হলো সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অতীতে আমরা বহুবার দেখেছি, ঢাকঢোল পিটিয়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হয়, সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা হয়, কিন্তু তার কিছুদিন পরেই সেই চারাগাছগুলোর আর কোনো খোঁজ থাকে না। পানির অভাবে, সঠিক যত্নের অভাবে কিংবা গবাদিপশুর পেটে গিয়ে হারিয়ে যায় সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন।

সাভারের এই এক লাখ চারাগাছের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ভর করছে স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর। এই গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রতিটি গাছের নিয়মিত পরিচর্যা, নিরাপত্তা এবং বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে এই মহৎ উদ্যোগটিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।

শুধু গাছ নয়, চাই দূষণের উৎসে আঘাত

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্যে সবচেয়ে আশার দিকটি হলো, তিনি শুধু গাছ লাগানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি দূষণের মূল কারণগুলোর দিকেও আঙুল তুলেছেন এবং সেগুলোর সমাধানের কথা বলেছেন।

১. ইটভাটা নিষিদ্ধকরণ: তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সাভার ও আশপাশের এলাকায় ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনা নিষিদ্ধ করা হবে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে, কারণ ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটার কালো ধোঁয়া অন্যতম প্রধান দায়ী। এই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হলে তা বাতাসের মানে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবে।

২. পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জন: ক্ষতিকর পলিথিন ও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এই প্লাস্টিক আমাদের ড্রেন, নদী-নালা ভরাট করে জলাবদ্ধতা তৈরি করছে এবং মাটি ও পানির পরিবেশ নষ্ট করছে।

৩. বর্জ্য পোড়ানো ও শব্দদূষণ বন্ধ: যেখানে-সেখানে বর্জ্য পোড়ানো এবং গাড়ির অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজানোর মতো বিষয়গুলোকেও তিনি সামনে এনেছেন। এগুলো ছোট ছোট অভ্যাস মনে হলেও সম্মিলিতভাবে আমাদের পরিবেশের বিশাল ক্ষতি করে।

এই বিষয়গুলো থেকে বোঝা যায়, সরকার শুধু উপসর্গ নিয়ে কাজ করতে চাইছে না, বরং রোগের মূলে গিয়ে চিকিৎসা করতে চাইছে। গাছ লাগানো হলো ফুসফুসকে শক্তিশালী করার মতো, আর দূষণের উৎস বন্ধ করা হলো বিষাক্ত উপাদান শরীরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার মতো। দুটোই সমান জরুরি।

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন: বড় প্রেক্ষাপটে সাভারের এই উদ্যোগ

বিশ্বজুড়ে এখন জলবায়ু পরিবর্তন একটি ভয়াবহ সংকট। অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, খরা, বন্যা—এসবই এর প্রত্যক্ষ ফল। এই বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

সাভারের এই এক লাখ গাছ হয়তো বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে পারবে না, কিন্তু এটি একটি শক্তিশালী প্রতীক। এই গাছগুলো বড় হয়ে স্থানীয় তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করবে, কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে বাতাসকে বিশুদ্ধ করবে এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য নতুন আবাসস্থল তৈরি করবে। প্রতিটি গাছই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লড়াইয়ে একেকজন নীরব সৈনিক।

যখন একটি দেশের নীতিনির্ধারকরা এবং সাধারণ মানুষ একসাথে স্থানীয় পরিবেশ রক্ষার কাজে নামে, তখনই বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়।

শেষ কথা

সাভারে এক দিনে এক লাখ গাছ রোপণের উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এটি আমাদের মনে আশা জাগায়। তবে এই আশাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। এই উদ্যোগকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে, যেখানে শুধু প্রশাসন নয়, প্রত্যেক নাগরিক তার নিজের দায়িত্বটুকু পালন করবে।

উপদেষ্টা একটি চারা রোপণ করে পথ দেখিয়েছেন। বাকি ৯৯,৯৯৯টি চারাগাছকে এবং লক্ষ কোটি গাছকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এখন আমাদের সকলের। তবেই ‘সবুজে বাঁচুক সাভার’ শুধু একটি স্লোগান হয়ে থাকবে না, একটি সবুজ বাস্তবতায় পরিণত হবে।

আপনার মতামত কী?

আপনি কি মনে করেন এই ধরনের উদ্যোগ পরিবেশ রক্ষায় সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে? এই উদ্যোগকে সফল করতে আপনার এলাকার জন্য কী করা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আপনার মূল্যবান মতামত নিচের কমেন্ট বক্সে জানান।

পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত এমন আরও বিশ্লেষণমূলক লেখা পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ